নতুন কথা ডেস্ক : “মাগো, অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?” মৃত্যুর আগের রাতে মাকে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন অগ্নীযুগের বীর কন্যা প্রীতিলতা। ৫ মে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এই অগ্নিকন্যার ১১০তম জন্মবার্ষিকী। ব্রিটিশ শাসকদের বুক কাঁপানো নাম প্রীতিলতা ১৯১১ সালের এ দিনেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। তার ডাকনাম রাণী, ছদ্মনাম ফুলতার। তার পিতা জগবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার হেড ক্লার্ক। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাস্টারদা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামে প্রীতিলতাকে প্রথম আত্মোৎসর্গকারী নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রীতিলতা চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।
এরপর তিনি ১৯২৯ সালে ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর দুই বছর পর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশনসহ গ্রাজুয়েশন করেন। ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে প্রীতিলতা লীলা নাগের নেতৃত্বাধীন দীপালি সংঘের অন্তর্ভুক্ত শ্রীসংঘের সদস্য এবং কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে কল্যাণী দাসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রীসংঘের সদস্য হন। গ্রাজুয়েশন করার পর তিনি চট্টগ্রামের নন্দনকানন অপর্ণাচরণ নামক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩০ সালে সমগ্র বাংলাজুড়ে অনেক বিপ্লবী দল সংগ্রামরত ছিলো। ওইসব দলের সদস্যরা বিশ^াস করতেন, কেবল সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যদিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন দলিলপত্র পাঠ থেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হন। প্রীতিলতার এক ভাই মাস্টারদাকে তার বিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে অবহিত করেন। প্রীতিলতা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম নারী সদস্য হন। তিনি টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস এবং রিজার্ভ পুলিশ লাইন দখল অভিযানে যুক্ত ছিলেন। তিনি জালালাবাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৩০ সালে প্রীতিলতা কলকাতার আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত রাজবন্দি রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে যথাসময়ে তা পালন করেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন ধলঘাট সংঘর্ষে কয়েকজন বিপ্লবী প্রাণ হারান। মাস্টারদা ও প্রীতিলতা পালাতে সক্ষম হন। অতিদ্রুত পুলিশের জরুরি গ্রেফতারি তালিকায় প্রীতিলতার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। মাস্টারদা তাকে স্কুল ছেড়ে দিয়ে পুরুষ বিপ্লবীদের মতো আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন। প্রীতিলতা অপর একজন বিপ্লবী নারী কল্পনা দত্ত যোশীসহ গোপন আস্তানায় চলে যান। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ’ এইরূপ অবমাননামূলক কথার জন্য ক্লাবটির দুর্নাম ছিলো। ক্লাব আক্রমণ সফল করে পুরুষবেশী প্রীতিলতা সামরিক কায়দায় তার বাহিনীকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই সময়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হলে তাৎক্ষণিকভাবে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার আত্মদান বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রামে আরো উজ্জীবিত করে তোলে। অগ্নিকন্যার জন্মদিনে সংগ্রামী অভিবাদন।