।। আব্দুর রউফ ।।
পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার ঘেরাটোপে চক্রবৃদ্ধিহারে পৃথিবীতে অভাবী মানুষে বেড়েই চলছে। পৃথিরীর প্রায় বেশিরভাগ সম্পদ অল্প কিছু মানুষের হাতে জিম্মি। যার ফলে মধ্যবিত্তরা নিম্নমধ্যবিত্তে, মধ্য নিম্নবিত্তরা একদম নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাড়িয়েছে অনেক দেশে বহুু মানুষ খাবারের অভাবে মৃত্যুবরণ করছে। গরিব অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষের অভাবের কান্নায় পৃথিবীর বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও যেন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তার চরিত্রের শিকল ভাঙছে না। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধনী শ্রেনীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। তার সর্ব উৎকৃষ্ট উধাহরণ বাংলাদেশ। এই করোনা ভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবী যখন সকল কিছু যখন থমকে গেছে, ঠিক তখনি দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে যখন বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় তখন দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার আমানতদারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৮২হাজার ৬২৫টি। অথচ গত সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮টিতে। অর্থাৎ ১এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপটেম্বর, এই ছয় মাসে দেশে ব্যাংকে কোটি টাকা রাখার আমানতদারী সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তত্ত্বের বিবরণীতে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে অতি ধনী বৃদ্ধির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধনী বৃদ্ধির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এটিই পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম গুণ। যেদেশে ধনীর সংখ্য বেড়ে যাবে সে দেশে নিশ্চিত গরিবের সংখ্যাও বেড়ে যাবে।
ধনী গরিবের বৈষম্য যখন চরম আকার ধারণ করছে। অসহায় মানুষগুলো যখন তিন বেলা খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে ঠিক তখনি পৃথিবীকে এক অদৃশ্য কোভিড-১৯ নামোর একটি ভাইরাস আক্রমন করলো। দেশে দেশে লক্ষ কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ এই ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করছে। প্রতিদিন নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুের রেকর্ড দেখেছে বিশ্ববাসী। দেশে দেশে ধারাবাহিক লকডাউন ও কারফিউ জারি চলছে। একদিকে যেমন করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে মানুষ ঘর বন্দি। অন্যদিকে এই ঘর বন্দি মানুষগুলোর জীবিকা নির্বাহের প্রায় সকল দরজা বন্ধ। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকে খেয়ে, না খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছে এই অসহায় মানুষগুলো। অনেক দেশেই মানুষ জীবিকার তাগিদে কাজের সন্ধানে ঘর থেকে বের হচ্ছে। দেশে দেশে চলছে লকডাউন বা বিধিনিষেধ বিরোধী বিক্ষোভ। বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। দেশে দ্বিতৃীয় দফায় কথিত সর্বাত্তক লকডাউনের বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকাসহ অনেক জায়গায় মানুষ প্রতিবাদ করেছে। এই প্রতিবাদ বিক্ষোভের কারণ রয়েছে। দেশের এই বিশাল গরীব অসহায় জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার রসদ না দিয়েই এমন সিদ্ধান্ত মানুষ মানতে চায়নি। যেকারণে অনেকেই এই লকডাউনের বিপক্ষে ছিলো। তবে সচেতন নাগরিকেগণ মনে করেন যদি সরকার এই গরিব মানুষগুলোর খাদ্যর যথাযথ ব্যবস্থা করে এমন কড়া বিধিনিষেধ জারি করতো তাহলে মানুষ মেনেও নিতো আর বাহিরে বের হতো না।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। আগে যে সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠী দেশে বসবাস করতো তার সাথে নতুন করে এই আড়াই কোটি মানুষ যোগ হয়েছে। গত ২১ এপ্রিল বেরসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়া অন্ড পার্টিসিপেশন রিচার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও বিআইডিজি এর যৌথ গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে ২০২১ সালের মার্চ প্রর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণীর জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে গ্রাম অঞ্চলের চেয়ে শহর অঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবছরের মার্চ প্রর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ। সেখানে গ্রামাঞ্চলে ৪৪ শতাংশ। এই সাথে মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে প্রায় দ্বিগুণ ঋণগ্রস্ত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাড়িয়েছে ৪ শতাংশে। শুধু করোনা ভাইরাসের প্রকোপে আগে কাজ ছিলো কিন্তু এখন নেই এমন মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৮ শতাংশ। সর্বপুরি দেশে এই সময়ে ১১শতাংশ মানুষের সঞ্চয় একাবারে কমে গেছে। আরো একটি তথ্য বলছে কোভিড-১৯ কালীন সময়ে প্রথম ৬মাসে দেশে শতাংশের দিক থেকে ধনী বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় চলে গেছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বলা যায় পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবতা আরো বেশি ভয়ংকর।
একদিকে মালিক শ্রেণীর শোষনের কষাঘাতে শ্রেমিকেরা যারা মূলত উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জড়িত তাদের জনজীবন বিপর্যস্ত। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের প্রোকোপে মানুষ দিশাহারা। প্রতিদিন কত শত প্রিয় মানুষকে হারাতে হচ্ছে। মা -বাবা তার কলিজার টুকরো সন্তানকে হারাচ্ছে। সন্তান তার বটবৃক্ষের ন্যায় পিতা-মাতাকে বিমূর্ষ হৃদয়ে বিদায় জানাচ্ছে। কত পরিচিত প্রিয় মুখ করোনা ভাইরাস আমাদের মধ্য থেকে কেড়ে নিচ্ছে। করোনা ভাইরাসের এমন বিরুপ আচরণের পরেও জীবিকার তাগিদে ভাইরাসকে উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়ে দাড়িয়েছে ভাইরাসের চেয়ে পেটের খুদা বেশি শক্তিশালী। সত্যিই তাই ভাইরাস যেমন মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে ঠিক তেমনি খাদ্যের অভাবে মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। বাহ্যিক দৃষ্টিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে পেটের খুদার অভাবে মারা যাওয়া বেশি কষ্টের। তাই তো এই মাহামারীর মধ্য মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটছে নিরন্তর। পৃথিবীতে এই অসহার দূর্বল শ্রেণীকে পুজিঁ করে মালিক শ্রেণী সম্পদের পাহাড় গড়তেছে। চলমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উৎপাদনের সাথে যারা জড়িত শ্রেমিক তাদের কোন লাভ নেই,বরং সমস্ত লাভ্যংশ চলে যাচ্ছে মালিকের পকেটে। ন্যায্য মজুরি চাইতে গেলেও এই পুঁজিবাদীদের পাহারাদার রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় শ্রেমিকদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। দূর্বলের উপর সবলদের এমন অত্যাচার সেই আদিকাল থেকে হয়ে আসছে। তাই এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে, এমন এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করতে হবে, যেখানে ধনী- গরিবের কোন বৈষম্য থাকবে না। মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার ঠিকমত বুঝে পাবে। সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
কোভিড-১৯ এর কারণে বাংলাদেশে দুবার লাকডাউনে গিয়েছে। বর্তমান যে লকডাউন চলছে সার্বিক দিক বিবেচনায় তা শুধু গরিবের জন্য কার্যকর করা হচ্ছে। যেকারণে রাস্তায় প্রাইভেট কার চললেও রিক্সা চালকদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে। নিন্ম আয়ের মানুষদের করা হচ্ছে হয়রানি ও জরিমানা। করোনার এই প্রকোপের মধ্য নিন্মআয়ের মানুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত না করেই গার্মেন্টস ও অন্য অন্য কলকারখানা খোলা রাখা হয়েছে। অপরদিকে যারা দিন এনে দিন খায় এমন পরিবার গুলো না খেয়ে দিন পার করছে। স্বাস্থ্যখাতকে দূর্নীত ও অবস্থাপনায় মানুষ অতিষ্ট। সব মিলিয়ে বর্তমান সব চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে একদম চরম দরিদ্রসীমায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী। সেই সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেমূল্যের লাগামহীন দাম মানুষের কষ্টের পরিসীমা বহুুগুনে বৃদ্ধি করেছে। কোনভাবেই বাজার সিন্ডিকেটের বৃত্ত থেকে সরকার বের হতে পারছে না। মুনাফালোভি ও মধ্যস্বত্বভোগী একদল অসাধু সিন্ডিকেটের নিকটে সরকার যেন অসহায়। এমত অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রনে সরকারের তেমন কোন জোড়ালো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। বাজার বিশ্লেষকগণ মনে করেন, বর্তমান সরকারের পৃষ্টপোষকতায় একদল মানুষ নিত্যপন্যের বাজার নিয়ন্ত্রন করছেন। পৃথিবীর অন্য সব মুসলিম দেশে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে দ্রব্যেমূল্যের দামে ছাড় দিলেও বাংলাদেশে দাম বৃদ্ধির অসম প্রতিযোগিতায় নামে ব্যবসায়ীরা। যেকারণে একজন নিন্মআয়ের মানুষের অরেক কিছু কেনার ইচ্ছা থাকলেও কিনতে পারে না। তাই তো বাজারে গিয়ে শতবার বাজার করার পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয় একজননিম্ন আয়ের মানুষের। অনেক কিছু ক্রয়ের ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে মানুষ তা কিনতে পারছে না।
বর্তমান পৃথিবীব্যাপী গরিব অসহায় ও অভাবী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাই বলা যায় করোনা যেমন একটি মাহামারি ভাইরাস, তেমনি অভাব একটি মাহামারি ভাইরাসের মতই। হঠাৎ এই অদৃশ্য ভাইরাস মানুষকে গরিব-অসহায় বা অভাবি মানুষ বৃদ্ধি করাতে একটি নতুন মাত্র যোগ করেছে। তবে শস্তির খবর হলো যুগে যুগে যেকোন ভাইরাস প্রতিরোধে নানা রকম ভ্যাকসিন আবিস্কার করা হয়েছে। সেই ভ্যাকসিনের সুফল মানুষ পেয়েছে। তবে অভাব যেন বেড়ে না যায় বা অভাবে একটি মানুষ যেন পৃথিবী মৃত্যুবরণ না করে তার ভ্যাকসিন তথা তা প্রতিরোধে বিশ্বের ক্ষমতাধর শাসকদের কোন উল্লেকযোগ্য পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। বরং দেশের পুঁজিবাদীদের পাহারাদারের ভূমিকায় রয়েছে বর্তমান দেশের শাসন ব্যবস্থা। তাই অর্থ উপার্জনের এই অসমনীতি বর্জন করতে হবে। দেশের অর্থনীতির বা উন্নয়নের সুষমবন্টন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে ভাইরাসে প্রতিরোধে যেমন নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে ঠিক তেমনি অভাবে যেন মানুষ না মৃত্যুবরণ করে সেই বিষয়ে জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীতে থেকে অভাব ও করোনা ভাইরাস দূরভীত হোক। যেন এক সুখী-সমৃদ্ধ পৃথিবী আমাদের নতুন প্রজন্মকে উপহার দিতে পারি সেই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।