সাদাকাত হোসেন খান বাবুঃ ২৮ অক্টোবর ২০০৬। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের দিন। বাংলাদেশ যুব মৈত্রী’র নেতা শহীদ রাসেল আহমেদ খান এদিন জীবন দিয়ে সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। বিএনপি-জামাত জোট রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় যে মিথ্যা আর ষড়যন্ত্রের নাটক মঞ্চায়ন করেছিল ২৮ অক্টোবর ছিল তেমনি একটি দিন। চার দলীয় জোটের ৫ বছরের দুঃশাসনের পর এই দিনটি ছিল তত্বাবধায়ক সরকারের হাতে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন। কিন্তু মসনদের মোহ আর ক্ষমতা হারানোর পর জন আক্রোশ থেকে বাঁচতে বিএনপি-জামাত জোট ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন আর ক্ষমতার অপব্যহার করে তারা যেসব অপকর্ম করে দেশের মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল তা থেকে রক্ষার কোনো উপায় নেই। এটা দক্ষিণপন্থী বিএনপি-জামাত জোট স্পষ্টভাবে’ই বুঝেছিল।তাই আবার ক্ষমতায় বসার রাস্তা পরিস্কার করতে জঘন্য চক্রান্তের আশ্রয় নেয়। বিএনপি’র সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতেপূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ীআরো আগেই সংসদে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে নেয়। বিএনপি-জামাত জোট মনে করছিল তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দীন আহমেদ আর তাদের ঘরের মানুষকে এম হাসান যদি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়, তবে নির্বাচনে তাদের বিজয়ী হওয়া ঠেকায় কে!
অনেক আগেই তাদের আজ্ঞাবাহপ্রধান নির্বাচন কমিশনারএম এ আজিজকে দিয়ে ১ কোটি ২০ লাখ ভূয়া ভোটার তৈরী করে রেখেছিল, যেন কোনোভাবেই নির্বাচনের ফলাফল তাদের বিপক্ষে না যায়। এখন প্রশ্ন হলো কেন নির্বাচনে পরাজয়ে এত ডর।কেন ক্ষমতা ধরে রাখার ষড়যন্ত্র?কারণ, ওই সময়ে বিগত ৫ বছরে বিএমপি-জামাত ‘চড়ষরঃরপং ড়ভ অহহরযরষধঃরড়হ’ এর রাজনীতি করেছে। নিসংশভাবে হত্যা করেছে ওয়ার্কার্স পাটি নেতা গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে। শ্রমিক লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাষ্টার, শাহ্ এস,এম কিবরিয়া, মমতাজ উদ্দীনসহ অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকাÐের হোতা ছিল বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার।
২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা করে আইভি রহমানসহ ২২ জনকে হত্যা করে। ঐ দিন তারা হত্যা করতে চেয়েছিল আজকের প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধীদলী নেত্রী শেখ হাসিনাকে। কেবল তাই নয় (২০০১-২০০৬) তাদের রাজত্বকালে চলেছে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় লুটপাট। দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত তারেক রহমানের ‘হাওয়া ভবন’ ছিল সমান্তরাল সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে খাম্বা ব্যবসার মাধ্যমে লুট করে শত শত কোটি টাকা। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে রাষ্ট্রীয় মদদে আমদানি করা হয় ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র। ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়। তৈরি হয় রাষ্ট্রের জঙ্গিবাদী ভাবমূর্তি। বাংলা ভাই, শায়েখ আব্দুর রহমান গং’রা ক্রমাগতভাবে দেশজুড়ে হত্যাকাÐ করে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে।ব্যাপক সমালোচনার মুখে জামাত নেতা বলেন “বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি”। আসলে তারা আফগানিস্তান স্টাইলে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চেয়েছিল। প্রকাশ্যে শ্লোগান তুলেছিল ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। ফলে ক্ষমতা হারালে এসব ভয়ঙ্কর অপরাধের জন্য তাদের যেন বিচারের সম্মুখীন হতে না হয়, তাই যেকোনো মূল্যে তারা আবারও ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল।
কিন্তু ‘৭১-এর সকল চেতনা আর মূল্যবোধ যখন ভূলুণ্ঠিত হতে লাগলো তখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রথম পল্টনের জনসভায় সাহসী উচ্চারণ করে “বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আর না”,“চার দলীয় জোট আর না”। ওয়ার্কার্স পার্টির এই সময়পোযী আহŸানে সাড়া দেয়মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল।প্রথমে ১১ দল, আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ নামে যাত্রা শুরু হলেও ২৩ দফার ভিত্তিতে তা ১৪ দলীয় জোটে রুপ নেয়। আওয়ামী যুব লীগ, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, জাতীয় যুব জোট, জাতীয় যুব ঐক্য, বাংলাদেশ যুব আন্দোলন, যুব সমিতি, যুবগণ ফোরাম নিয়ে গঠিত হয় যুব সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় লুটপাট, জঙ্গিবাদের ধারায় রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবার সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে ১৪ দল-এর নেতৃত্বে দেশবাসী, যুব সংগ্রাম পরিষদ আরছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজপথ দখলের কর্মসূচী হাতে নেয়। ২৭ অক্টোবর ২০০৬, বেগম খালেদা জিয়া তার ক্ষমতা ছাড়ার আগের দিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ছাত্র-যুব ও জনগণের প্রতিরোধ লড়াইয়েবিচারপতি কে এম হাসানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান না হওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তখন বিএনপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি অন্য ৪টি বিকল্প বাদ দিয়ে একই সাথে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। যা ছিল ইতিহাসে এক নির্লজ্জ উদাহরণ। খালেদা-নিজামী সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জন আক্রোশে সেদিন অগ্নিগর্ভ হয়েছিল রাজধানীর পল্টন চত্তর। এ সময় বায়তুল মোকাররম-এর উত্তর গেটে ছিল জামাত শিবিরের সশ¯্র ক্যাডাররা। নয়াপল্টনে জনসভা করছিল বিএনপি। আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ ছিল ১৪ দলের ‘জন জমায়েত’।
সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউ অভিমুখে জনতার ঢল নেমেছিল। কিন্তু বায়তুল মোকাররমে অবস্থিত শিবির ক্যাডাররা ঘোষণা দিল ‘বৃষ্টির মত গুলি কর’পুলিশের সহায়তায় যখন তাদের এই তাÐব চলছিল, পল্টনে তখন লাখো মানুষের ঢল। এ সময় তাদের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয় ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মী ও যুব মৈত্রী’র নেতা কমরেড রাসেল আহমেদ খান। দ্রæত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সারাদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সন্ধ্যায় ইতিহাস হয়ে যান কমরেড রাসেল। খালেদা-নিজামী সরকারের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী ভূমিকার সুচনা অনেক আগে থেকেই। ’৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামরিক স্বৈরাশাসক জিয়উর রহমান লাখো শহীদের রক্তে তৈরি সংবিধানে প্রথম ছুড়ি চারিয়ে ৫ম সংশোধীর মাধ্যমে পাল্টে দেয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির পরিবর্তন করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাতিল করে। পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র, সরকার আর সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করে। তারই ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদ আবারো সংবিধানে ছুড়ি চালিয়ে ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তন করে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম।
যুব-ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে টিকে থাকতে পারলো না ইয়াজউদ্দীনের সরকার। ২০০৭-এর জানুয়ারির ১১ তারিখে ক্ষমতা দখল করলো সেনা সমর্থিত ফকরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সরকার। ২ বছর ক্ষমতা ধরে রাখার পর অবশেষে ২০০৮ সালে তারা জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট ‘ভূমিধ্বস’ বিজয় লাভ করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশের শাসনভার পরিচালনা করছে ১৪ দলীয় জোট সরকার। অথচ আজ স্পষ্টতঃ দেখা যাচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শহীদ রাসেলের সেই লড়াই পাশ কাটিয়ে বর্তমান সরকার মৌলবাদী হেফাজতের সাথে সমঝোতা করেছে। তাদের ইচ্ছার কাছে নত হয়ে পাঠ্য পুস্তকে মৌলবাদী ভাবধারা আনা হয়েছে। হাওয়া ভবন, খোবাব ভবনের লুটপাট আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাসেলের সেই জীবনদান আজ বালিশকাÐ, ক্যাসিনোকাÐ, হলমার্ক কেলেঙ্কারী, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, শাহেদ পাপিয়া, পি কে হালদার গংয়ের কাছে অসহায়। ১৪ দল, যুব সংগ্রাম পরিষদ আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সম্মিলিত সংগ্রামের ফসল আজকের এই সরকার উপেক্ষা করছেন জনতার রাজনৈতিক শক্তি। আস্থা রাখছেন কেবলমাত্র আমলাতন্ত্রের ওপর। তাই কমরেড রাসেল আহমেদ খানের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শপথ রাসেলের লড়াইটা আজো চালিয়ে যেতে হবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ যুব মৈত্রী’র সাবেক সভাপতি ও তৎকালীন যুব সংগ্রাম পরিষদ নেতা।