নতুন কথা ডেস্ক ॥ ভয়-দ্বিধাহীনভাবে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের কণ্ঠস্বরের নাম বিরসা মুন্ডা। মাত্র ২৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন হলেও সাহস আর বীরত্বপূর্ণ কর্মকা-ের মাধ্যমে তৈরী করেছিলেন অসংখ্য অনুসারী। মুক্তির পথ দেখানো বিরসা মুন্ডা মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ভগবান বিরসা মুন্ডা।
অকুতোভয় এই বীর সেনার জন্ম ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের উলিহাতু গ্রামে। আদিবাসী মুন্ডা পরিবারে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছে তার শৈশব। ওই সময়ে শোষণকারী ব্রিটিশ শাসকরা মধ্য ও পূর্ব ভারতের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করতে শুরু করে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে আদিবাসীদের ঐক্যকে বিঘিœত যেমন করে, তেমনি ছোট নাগপুর অঞ্চলে আদিবাসী গোষ্ঠীর ‘খুনকাট্টি’ কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে একটি সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী প্রথা চালু করে। ব্রিটিশ শাসকরা মহাজন, ঠিকাদার, বহিরাগতদের নিয়ে আসে। সেইসাথে সামন্ত জমিদারকেও, যারা আদিবাসীদের শোষণে ব্রিটিশদের সহায়তা করে। বনবাসী আদিবাসীদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক লোকাচারকে অপমান এবং হস্তক্ষেপ করে মিশনারি ক্রিয়াকলাপ নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্রিটিশ শোকদের সক্রিয় সমর্থনে কাজ করতে থাকে।
তরুণ বিরসা তার চোখের সামনে সামনে দেখেন ব্রিটিশ শোষকরা কীভাবে স্থানীয় জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ কছে। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জ¦লে উঠতে থাকে। সে সময়ের জমিদারী ব্যবস্থা সহসাই আদিবাসীদের জমির মালিকের মর্যাদা থেকে ভূমি শ্রমিকের মর্যাদায় নামিয়ে আনে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থাপন বনাঞ্চলের উপজাতীয় এলাকায় জোরপূর্বক শ্রম (ভেথবিগারি) তীব্রতর করে।
এই সমস্ত কিছুকে বিরসা আদিবাসীদের বিদ্রোহের কারণ হিসেবে গ্রহণ করেন। উপজাতীয় জীবন ও সংস্কৃতিকে অপমান করা মিশনারিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আদিবাসীদের ধর্মীয় আলো দেখিয়েছিলেন।
তিনি বিরসা ধর্মীয় রীতিনীতি পরিশোধন এবং সংস্কারের জন্য কাজ করেছিলেন, অনেক কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচারকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। নতুন নীতি, নতুন প্রার্থনা নিয়ে এসেছিলেন, অনেক অভ্যাসের সংস্কার করেছিলেন এবং জনজাতিদের গর্ব পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি জমির উপর আদিবাসীদের পৈতৃক স্বায়ত্তশাসন নিয়ন্ত্রণে সার্বভৌমত্বের আহ্বান করেছিলেন। বিরসা এসবের মধ্য দিয়ে বিরসা হয়ে উঠেন গণনেতা, জনজাতির জীবনমানের পরিবর্তনের ভগবান রুপে।
বিরসা মুন্ডা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছিলেন আদিবাসীদের সকল সমস্যা ও নিপীড়নের মূল কারণ ব্রিটিশ শাসক। ‘মহারানীর রাজ্য শেষ, আমাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক’-এই মন্ত্রে তিনি তিনি জনসাধারণের মনে স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে ছিলেন। মুন্ডা, ওরাং ও অন্যান্য আদিবাসী এবং অআদিবাসীরা তার আহ্বানে সাড়া দেন। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য বিরসার নেতৃত্বে ব্রিটিশ শোষক বিরোধী ‘উলগুলান’ বা বিদ্রোহে যোগ দেন। ঐতিহ্যবাহী তীর-ধনুক দিয়ে মধ্য ও পূর্ব ভারতের আদিবাসীরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিরসা তাদের জীবনীশক্তি এবং দেবত্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন। লড়াইয়ের এই বীরকে ব্রিটিশ পুলিশ বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সেখানেই ১৯০০ সালের ৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু বিরসা মুন্ডার সংগ্রাম বৃথা যায় নি। আদিবাসীদের সংগ্রাম ব্রিটিশ শাসকদের আদিবাসীদের দুর্দশা এবং শোষণের বিষয়টিকে বিবেচনা নিতে বাধ্য করে। তাদের সুরক্ষার জন্য ‘১৯০৮ সালের ছোট নাগপুর টেনেন্সি অ্যাক্ট’ নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসীদের কাছে হস্তান্তর করা বন্ধ করে। ব্রিটিশ শাসকরাও ভেথবিগারি বা জোরপূর্বক শ্রম বিলুপ্ত করার পদক্ষেপ নেয়।
বিরসা মুন্ডা’র লড়াই আজো ভারতীয় এবং এদেশীয় আদিবাসী-বাঙালিদের অনুপ্রাণিত করে। তিনি বীরত্ব, সাহস এবং নেতৃত্বের আইকন।