Site icon নতুন কথা

আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরুত্থান দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সতর্ক সংকেত

Afghan Taliban militants and villagers celebrate the U.S. peace deal Monday in the Alingar district of Laghman Province. The group resumed offensive operations against Afghan security forces this week, ending a partial truce.

।। ফজলে হোসেন বাদশা ।।                      
কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা

জুলাইয়ের শুরুতেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সৈন্যদের শেষ অংশ আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম বিমান ঘাটি ছেড়েছে। বছর কুড়ি ধরে এই বিমানঘাটি থেকেই তারা দেশটিতে আল কায়েদা ও তালেবানদের ওপর হামলা চালিয়ে এসেছে। আফগান মাটি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার পুরোপুরি সম্পন্ন করার যে মার্কিন ঘোষণা, সেই প্রক্রিয়ারই অংশ এটি।

এর কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র সফররত আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সঙ্গে বৈঠক হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। বৈঠকের পর বাইডেন যা বলেন, তার সহজ বাংলা হলো, এরপর যা কিছু ঘটবে সে ব্যাপারে আফগানিস্তানকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদিও সহায়তা অব্যাহত রাখার কথা বলেন তিনি। মানে, ব্যাপার একদম পরিস্কার-ভূরাজনীতির ঘুটি হিসেবে দীর্ঘ ব্যবহারের পর প্রায় কুড়ি বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বিবর্ণ আফগানিস্তানের পরিস্থিতির ব্যাপারে কোনো দায়দায়িত্ব আর নিতে চায় না মার্কিন প্রশাসন।

যে সময় বাইডেন এই নসিহত দিচ্ছেন, সেই সময়ই একদিকে নাটো সেনারা চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে তালেবানরা আফগানিস্তান দখলের অভিযানে নেমেছে।পশ্চিম আফগানিস্তানের গ্রামের দিকের এলাকায় তালেবান তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এবার তারা শহরের দিকে এগোচ্ছ। তারা জেলাগুলো দখল করছে। যে বাগরাম ঘাটি এতদিন আফগান বাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে, তা পাবার সুযোগ আর নেই। তাই পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হচ্ছে। এমনকি তালেবান আক্রমণের মুখে পড়ে ২৮০ জন আফগান সেনা তাজিকিস্তান চলে গেছে, এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কদিন আগেতালেবান আঞ্চলিক রাজধানী আক্রমণ শুরু করেছে। পশ্চিম আফগানিস্তানে কালা-ই-নও আক্রমণের পর সেখানে আফগান বাহিনীর সঙ্গে তালেবানদের সংঘাতের খবর এসেছে। সবমিলিয়ে ফের টালমাটাল আফগানিস্তান উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সবার।

এক শতাব্দীর মধ্যে গণতন্ত্রায়ণ বা সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে এমন জটিলতা তৈরি করে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাকে ‍উস্কে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসারণ নতুন কিছু নয়।তাদের নেতৃত্বাধীন যেকোনো সামরিক জোটের পরিণতিই শেষাবধি একই ধারায় ঠেকেছে। আফগানিস্তানের আগে ভিয়েতনাম ও ইরাকেও তারা একই কাজ করেছে। ভিয়েতনামের পরিণাম বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করলেও ইরাকের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ।

একথা আর কারও অবিদিত নেই যে, ইরাকে যেসব কারণ দেখিয়ে হামলা শুরু করেছিলো ইঙ্গ-মার্কিন জোট, সেগুলোর অধিকাংশই ছিলো ভিত্তিহীন। কিন্তু সেই কাজটির পরিণতিই বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদের নতুন উত্থানের পথ তৈরি করে দেয়। তৈরি হয় ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর মতো উগ্র সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি বাহিনীর। শুধু ইরাক নয়, এই সংগঠনটি ডালপালা মেলতে শুরু করে দুনিয়াজুড়ে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে এক বড় সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই ইরাক ত্যাগের কথা মাথায় আসেন মার্কিন প্রশাসনের। স্বভাবসুলভ অদ্ভূত বৈপরিত্য তৈরি করে নেয়া এই সিদ্ধান্তের মূল্য আরও কত সহিংসতা দিয়ে যে মধ্যপ্রাচ্যকে দিতে হচ্ছে এবং হবে, তার হিসেব টানা মুশকিল।

ঠিক একই কায়দায় আফগানিস্তানেও রক্তক্ষয়ের শঙ্কা তৈরি করে বিদায় নিচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। এ মাসের মধ্যেই তড়িঘড়ি নেয়া এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হতে পারে। কিন্তু দিনের আলোর মতো যে ব্যাপারটি স্পষ্ট, তা হলো, কুড়ি বছর ধরে এই বাহিনী আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে যা করেছে, তা পুরোপুরি ব্যর্থ।তা নাহলে তাদের বিদায়ের ঘোষণায় তালেবানরা শক্তি পায় কীভাবে? বিপরীতে আফগান বাহিনীর মনোবল হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা কেন বিশ্বমিডিয়ায় আলোচনায় আসছে? সব মিলিয়ে বুঝতে বাকি থাকে না, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বলে পশ্চিমারা যাদের নিয়ে গলা ফাটিয়ে এসেছে, আফগানিস্তানে তাদের পূর্ণশক্তির প্রত্যাবর্তন ঘটার মতো যথেষ্ট উদ্বেগজন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদিন বাহিনীর সমন্বয়ে নব্বইয়ের গোড়ায় যে তালেবান বাহিনী গড়ে উঠেছিলো, তার পেছনে মার্কিন আনুকূল্যের কথা ভূরাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন তথ্য নয়। ১৯৯৬ সালে বুরহানুদ্দিন রব্বানির সরকারকে উৎখাত করে রাজধানী কাবুল দখল করে তালেবানী শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রটির দুর্দশাও বেশিদিন আগের ইতিহাস নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তালেবান-বিরোধী তৎপরতা মূলত শুরু হয় নাইন এলেভেন টুইন টাওয়ার হামলার পর।২০০১ সালের পর থেকে এই কুড়িটা বছর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী মুখে অনেক কথা বললেও দেশটিতে শান্তি ফেরাতে পারেনি। আবার আজ যখন অশান্তির পুরনো আগুন নতুন চেহারায় ফেরার উপক্রম হয়েছে, তখন এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন বলছেন যে, তালেবানদের উত্থানের পেছনে পাকিস্তান দায়ী! যদিও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক, বহুমাত্রিক সহায়তার মাধ্যমে যে পুরো প্রক্রিয়াটিকে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষে মদদ জুগিয়ে গিয়েছে, সেই সত্যটা তিনি বেমালুম চেপে গিয়েছেন।তার মতো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমাননীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগই আড়াল করেন যে, দুনিয়াজুড়ে তারা যে যে অঞ্চলে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে, সেসব অঞ্চলেই জঙ্গিদের উত্থান ঘটেছে। খুব খেয়াল করলে দেখা যায়, শেষ বিচারে এসব জঙ্গিদের উত্থান ও তৎপরতা তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থকেই আনুকূল্য দিয়েছে। যদিও তা টালমাটাল করেছে বিশ্বের নানা এলাকা।আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নিয়েও আমাদের উদ্বেগটা সেখানেই।

আমরা দেখেছি, আফগানিস্তানে তালেবানদের প্রতিষ্ঠায় শুধু সেই রাষ্ট্রেই এর প্রভাব থেমে থাকেনি। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এমনকি ভারতও এর প্রভাব থেকে বাদ যায়নি। বাংলাদেশে উগ্রপন্থিদের সঙ্গে তালেবানদের যোগাযোগ স্থাপন তো হয়েছিলোই, মৌলবাদী রাজনীতির সঙ্গেও নিবিড় ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় তাদের।নব্বইয়ের দশকে তাদের মিছিলেই আমরা স্লোগান দিতে শুনেছিলাম-বাংলা নাকি আফগান হবে আর তারা নাকি সবাই তালেবান হবে!

তাদের সেই স্লোগান যে ফাঁকা বুলি ছিলো না, দিন যত গড়িয়েছে, বাংলাদেশে ততোই তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়েছে।আমরা এদেশ থেকে তথাকথিত মুজাহিদিনদের আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করার তথ্য প্রমাণ পেয়েছি। দেশে ফিরে তারা শুধু হরকাত-উল-জিহাদ বা হুজির মতো জঙ্গি সংগঠনই সৃষ্টি করেনি, দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক মিত্র বেছে নিয়ে কৌশলে নিজেদের সংগঠনের প্রসার ঘটিয়েছে, সেই তালেবানি চ্যানেলেই অর্থ পেয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান যে কতোটা প্রভাব ফেলেছিলো, জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসির আগে দেয়া জবানবন্দি পড়লে আরও স্পষ্ট হয়। বাংলাভাইয়ের হাত ধরে জেএমবি মাঠে নামার আগে শায়খ আবদুর রহমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানী জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলো। হুজির সঙ্গে সেই সূত্র ধরেই তার বৈঠকও হয়েছিলো। দেশে প্রগতিশীল রাজনীতির ঐক্য শেষ পর্যন্ত তাদের সফল হতে দেয়নি। কিন্তু তা বলে তারা তো থেমে নেই।

সংবাদমাধ্যমে এসেছে, দেশে কিছুদিন আগে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে গোয়েন্দারা আফগানফেরত জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। তারা নানা কৌশলে কাজ করছে। জেএমবির বর্তমান আমির সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ভারতে বসে দেশে জঙ্গিদের সংগঠিত করছে। মাস কয়েক আগে ঢাকায় আটক এক জঙ্গি স্বীকার করেছে, সে ভারতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন করতে কোনো কষ্ট হয় না যে, আফগানিস্তানে তালেবানদের পূর্ণশক্তিতে প্রত্যাবর্তন আবারও আমাদের দেশে এই উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীকে নতুন করে সন্ত্রাসী তৎপরতার রসদ জোগাতে পারে।

এই বিপদ কি শুধু আমাদেরই? দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় রাষ্ট্র ভারতও এর প্রভাবের বাইরে থাকতে পারবে না। জেএমবির সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করেছে, এমন খবর সেদেশের সংবাদমাধ্যমেই এসেছে। আবার যে ঘটনাটিকে নিয়ে হেফাজতের তাণ্ডব, সেটিও ছিলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকেন্দ্রিক।আবার আফগানী তালেবানদের শক্তি বৃদ্ধি কাশ্মির নিয়েও নতুন সংকট তৈরি করে কি না, সে আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। পাকিস্তানের ভেতরে তালেবানদের যে অবস্থান তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ফলে রক্তাক্ত ইরাক যেমন মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এশিয়া অবধি প্রভাব ফেলেছিলো, তেমনই সংঘাতময় আফগানিস্তান প্রকৃতপক্ষে পুরো দক্ষিণ এশিয়াকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

কাজেই, আফগানিস্তানকেন্দ্রিক ভবিষ্যত সংকট নিয়ে আমাদের এখনই মনোযোগী হতে হবে। এটা কোনো একক রাষ্ট্রের মাথাব্যথার বিষয় নয়।সম্মিলিতভাবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো এই ইস্যুতে কাজ করতে না পারলে আগামীতে সবাইকেই এর মাশুল গুনতে হবে। সেক্ষেত্রে যেহেতু আফগানিস্তানও যুক্ত রয়েছে, তাই, দক্ষিণ এশিয়ার মৃতপ্রায় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে,সার্বিক নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে পারস্পরিক সহায়তা তৈরির মাধ্যমেই কেবল দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এশিয়াকেও শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের পথ অন্নেষণের পন্থা খুজে বের করতে হবে।

ফজলে হোসেন বাদশা: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য

Exit mobile version