॥ আব্দুর রউফ ॥
বর্তমান সমাজে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় প্রধানত উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত-এই তিন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। আবার মধ্যবিত্তের মধ্যে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা একটু দুর্বল তাদের তাদের বলা হয় নিম্ন মধ্যবিত্ত। অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরে মতে, যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ, মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে, যাদের বেতনের বাইরে বাড়তি আয় নেই, তাদের মধ্যবিত্ত বলা হয়। অর্থাৎ উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাদের বসবাস, তারাই মূলত মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের সজ্ঞা যাইহোক আমাদের সমাজে বসবাসরত এই তিন শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা ও অবজ্ঞার শ্রেণীটি হলো মধ্যবিত্ত। তাদের আর্তনাদ একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কখনো লোকলজ্জার ভয়ে, আবার কখনো সামাজিক সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে মধ্যবিত্তরা কারো কাছে হাত পেতে কিছু চাইতে পারে না। এই সমাজে মধ্যবিত্তকে সর্বদাই সংগ্রাম করে জীবনযাপন করতে হয়। অনেকের মতে বর্তমান বাস্তবতায় একদম নিম্নবিত্তের চেয়েও হিসাব-নিকাশ করে চলতে হয়।
মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতার অন্ত নেই। শত পরিকল্পনা করেও সংসার চালানোই দায়। একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের প্রতিনিয়ত মধ্যবিত্ত-নি¤œমধ্যবিত্তরা একদম নি¤œবিত্তে পরিণত হচ্ছে। নি¤œবিত্তে পরিণত হওয়ার সংখ্যা এতই বেশি যে তা বেশ উদ্বেগজনক। যদিও বাংলাদেশে কোনো সরকারের আমলেই মধ্যবিত্তদের নিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। প্রত্যেক বছরই বাজেটে নিম্ন আয়ের এবং হতদরিদ্র মানুষের জন্য সুযোগ সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হয়। মধ্যবিত্তরা সর্বদাই বঞ্চিত থাকেন।
মধ্যবিত্তদের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা স্বার্থে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানাগেছে,আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ফি বছরের ন্যায় এবারো বিশাল অংকের এই বাজেটেও মধ্যবিত্তদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাদের সুবিধা প্রদানের কথাও শোনা যাচ্ছে না।
অথচ মধ্যবিত্তরা শুধু সমাজকেই টিকিয়ে রাখে না, বরং তারা অর্থনীতির চালিকাশক্তিও। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মাঝের স্তরটির অবক্ষয়ের অর্থ সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের মতে, ‘এ দেশের অর্থনীতিতে নিম্নমধ্যবিত্তরা বিশাল অবদান রাখছে। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব খাতে তারা বড় ভূমিকা রাখছে। এসএমই খাতের মাধ্যমে আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশ তারাই অবদান রাখে। কিন্তু যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশাল এই জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত হয়। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, বর্তমান বাংলাদেশ যে হারে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মধ্যবিত্তের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে তা বেশ উদ্বেগজনক। ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মারাত্মকভাবে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। তাই সরকারকে মধ্যবিত্তদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আহ্বান জানাচ্ছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
বিগত কয়েক বছর থেকে দেশে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখীর কারণে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তরা অনেক কষ্টে জীবন যাপন করছেন। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবককে বাজারে গিয়ে প্রতিনিয়তই পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়। নিত্য পণ্যের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে অনেক ইচ্ছাই অপূরণীয় থাকছে। জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে টিকে থাকতে দিশেহারা দেশের মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তরা।
এই শ্রেণির মানুষদের মাকাল ফলের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। মাকাল ফল যেমন ওপরে সুন্দর দেখালেও ভিতরে দুর্গন্ধ, ঠিক তেমনই মধ্যবিত্তদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেক সুখে আছে মনে করা হলেও বাস্তবে ত দের অবস্থা করুন। সামাজিক সীমাবদ্ধতা আত্মসম্মানবোধের কারণে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত এখন এই শ্রেণী। এরা পায় না সরকারিভাবে সরকারি সহযোগিতাও পায় না, কারো কাছে হাত পাততেও পারে না। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কাটছে তাদের জীবন।
আমাদের সমাজের মধ্যবিত্তদের একটি অংশ যারা নিম্মমধ্যবিত্ত তারা সাধারণত কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিজস্ব স্বল্প কিছু জমিতে চাষাবাদ করেই সংসার পরিচালনা করেন। কিন্তু কয়েক বছর থেকে এই নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষকরাও একদমই ভালো নেই। একদিকে উচ্চমূল্যে সার-বীজ ও পানি সেচ দিয়ে ফসলের কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় নিদারুণ কষ্টে কাটছে দিন। বিশেষ করে ধান রোপণ ও মাড়াই করার সময় কাজের মানুষ মিলছে না। মিললেও দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য। এই শ্রেণি মাঠে গিয়েও ধান কাটতে পারছেন না, আবার শ্রমিকের চড়া দাম দিলে তাদের কিছুই থাকছে না। এখন কৃষক জমি হারাচ্ছেন, আবাদে অনীহা প্রকাশ করছেন। আর গ্রামের দিনমজুর, ভ্যান-ভটভুটি চালকরা অন্যের জমি লিজ নিয়ে কৃষক হচ্ছেন।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জীবনযাত্রার মান এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছে যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষকেরা সেই দিনমজুরের চেয়েও নাজুক অবস্থায় আছেন। উন্নয়নের যাঁতাকলে কৃষক ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠেছে। প্রকৃত কৃষকরা না হতে পারছেন দিনমজুর, না হতে পারছেন কৃষক। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষিজমি বন্ধক রাখছেন। এই অবস্থা এখন গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্তদের। তবে অর্থনীতির ভাষায় একটি দেশের উন্নয়নে সব চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। উন্নয়নের যাঁতাকলে পড়ে সেই মধ্যবিত্তরা আজ কাঁদছে নীরবে। তাদের এ কান্না থামবে কবে!-প্রশ্ন সেখানেই। এই নীরব কান্না থামাতে সবার আগে এবারের বাজেটে তাদের বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। তা না হলে মধ্যবিত্তের নীরব কান্না আরো বাড়বে।
লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।