॥ শান্তনু দে ॥
মাত্র ৬৭ শব্দের একটি ঘোষণা। যে ঘোষণায় ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের বিভাজনের ছক কষেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। যার পরিণতিতেই প্যালেস্তাইনের বুকের ওপর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা এবং যার পর থেকে কখনোই মর্যাদা দেওয়া হয়নি আরব জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে। যা জন্ম দিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে ‘জঘন্য’ দীর্ঘস্থায়ী, অমীমাংসিত সংঘাতের। যার জেরে আজো অশান্ত অস্থির, রক্তাক্ত মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চল।
ইসরাইয়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা যুদ্ধে রয়েছি!’ কিন্তু, এটা কোনো খবরই নয়।
ইজরায়েল শুরু থেকেই ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হয়েও ফিলিস্তি জনগণ, আরব এবং প্রগতিশীল জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রয়েছে। সেই ১৯১৭-তে, বালফোর ঘোষণা থেকে। খবর হলো, ‘যুদ্ধে, ইসরাইলের সবচেয়ে শোচনীয় দিন’। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় টমাস ফ্রিডম্যানের উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনামে অসহায় আর্তনাদ। স্বাভাবিক। শনিবার সকাল সাড়ে ৬টা। তখনো শহরগুলির আড়মোড় ভাঙে নি। আচমকা আকাশ ধোঁয়ায় ঢেকে ইসরাইলের মাটিতে বন্যার জলের মতো আছড়ে পড়তে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র। খোলা আকাশের নিচে কারাগার ছেড়ে বেরিয়ে হামাস যোদ্ধারা প্যারাগ্লাইডিং করে সমুদ্রপথে এবং গাড়ি নিয়ে দক্ষিণের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে ইসরাইলে। অভূতপূর্ব। দিনের শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ঘোষণা, ৩০০ জনের বেশি মুত্যু, জখম অন্তত দেড় হাজার। অন্যদিকে, পালটা ইসরাইলি বিমান হানায় নিহতের সংখ্যা অন্তত ৩১২। খবর হলো, পশ্চিম এশিয়াতে ক্ষমতার ভারসাম্যের তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো পরিবর্তন, সিরিয়াতে অস্থিরতা তৈরিতে চরম ব্যর্থতা এবং ব্রিকসের উত্থান।
খবর হলো, সাতটি আরব দেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনেরও ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আবেদন। সাতটি দেশ হলো: আলজেরিয়া, মিশর, সৌদি আরব, আরব আমিরশাহি, বাহারিন, কুয়েত এবং মরক্কো। আগস্টে জোহানেসবার্গে ব্রিকসের বৈঠক থেকে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, আর্জেন্টিনা, আরব আমিরশাহি ও সৌদি আরবকে পূর্ণ সদস্য হিসেবে ঘোষণা।
সাম্রাজ্যবাদকে যা হতচকিত করে দিয়েছে তা হলো ফিলিস্তি হামাস যোদ্ধাদের বেপরোয়া সাহস আর স্পর্ধা! খবর হলো, নেতানিয়াহু চান মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র, যেখানে পুরোপুরি মুছে ফেলা হবে ফিলিস্তিনকে।
খবর হলো, প্রজেক্ট-ইউক্রেন নিভন্ত। মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের চাই নতুন যুদ্ধ। শান্তিপূর্ণ পশ্চিম এশিয়া মানে সিরিয়াতে পুনর্র্নিমাণ, ইরাক আর লেবাননে নতুন করে উন্নয়ন। রাশিয়া-চীনের স্ট্রাটেজিক অংশীদারিত্বকে মধ্যপ্রাচ্যের সকলেই দেখছে শ্রদ্ধার চোখে। বাড়ছে ডলার-বিমুখতা।
খবর হলো, ব্রিকসে আলোচনার কেন্দ্রে ডি-ডলারাইজেশন। মার্কিন ডলারের আধিপত্য কাটিয়ে ভিন্ন মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা। বিকল্প হিসেবে ব্রিকসে অভিন্ন মুদ্রার ভাবনা।
এবছর নাকবা’র পঁচাত্তর। আরবিতে ‘নাকবা’ অর্থ বিপর্যয়। ফিলিস্তিনের বুক চিরে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৮ সালের ১৫ মে সাড়ে সাত লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের স্বদেশভূমি থেকে উৎখাত করা হয়, যখন জনসংখ্যা ছিল উনিশ লক্ষ। ফিলিস্তিনিরা এই দিনটিকে দেখেন ‘আল-নাকবা’ হিসেবে। যদিও এই ব্লুপ্রিন্ট তারও বহু আগের। ২ নভেম্বর, ১৯১৭। তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী আর্থার বেলফোর একটি চিঠি দেন ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা লর্ড ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে। আর তাতে ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন বেলফোর। সাত দিন বাদে প্রকাশিত হয় সেই ঘোষণা। ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ বা বেলফোর ঘোষণা নামে যা পরিচিত।
মাত্র ৬৭ শব্দের একটি ঘোষণা। যে ঘোষণায় ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের বিভাজনের ছক কষেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। যার পরিণতিতেই প্যালেস্তাইনের বুকের ওপর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা এবং যার পর থেকে কখনোই মর্যাদা দেওয়া হয়নি আরব জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে। যা জন্ম দিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে ‘জঘন্য’ দীর্ঘস্থায়ী, অমীমাংসিত সংঘাতের। যার জেরে আজো অশান্ত অস্থির, রক্তাক্ত মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চল।
১৯৬৭ থেকে কার্যত অধিকৃত পুরো ফিলিস্তিন। আজ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড আছে ঠিকই। কিন্তু পুরোদস্তুর রাষ্ট্র নেই। ১৯৯৩-তে অসলো চুক্তিতে অধিকৃত এলাকার কিছু অংশে ফিলিস্তিন অথরিটির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের কিছু অধিকার মিলেছে মাত্র। তবে ওই পর্যন্তই। আজো গড়ে ওঠেনি স্বাধীন প্যালেস্তাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। যেমন বলেছেন ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস, নাকবা ‘যেমন ১৯৪৮ সালে শুরু হয়নি, তেমনই ওই দিনের পরেই শেষ হয়ে যায় নি।’
জাতিসংঘের স্পষ্ট ঘোষণা, ইসরাইলের দখলদারি অবৈধ। পাত্তা দেয় না ইসরাইল। এই সময়ে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ১ হাজারের বেশি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘে। কিন্তু একটিও বাস্তবায়িত হয় নি। একরত্তি ইসরাইল এই স্পর্ধা দেখাতে পারে, কারণ পিছনে আছে আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠিয়েই ক্ষান্ত থাকে নি। সমস্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরাইলকে সমর্থন জানিয়েছে ওয়াশিংটন। ১৯৭৬ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান চেয়ে যে প্রস্তাব নেয় তাকে ‘ভেটো’ দিয়ে খারিজ করে দেয় আমেরিকা। একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাশে দাঁড়িয়েছে ওয়াশিংটন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ও ফিলিস্তিনিদের উপরে আগ্রাসনের নীতি চালিয়ে যাওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারছে ইসরাইল।
বিপরীতে, ফিলিস্তিনের রাস্তায় আজো রক্তের স্রোত। শব মিছিল। কারণ ওয়াশিংটন। আজকের ‘এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির তৈরির জন্য সম্পূর্ণ দায়ী নেতানিয়াহুর ফ্যাসিস্ট সরকার।’ এক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলেছে ইসরাইলের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দল হাদাস। যোগ করেছে, ‘ফ্যাসিস্ট দক্ষিণপন্থী সরকার দখলদারিকে চিরস্থায়ী করার জন্য পরিস্থিতিকে যে আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এমনকি এই কঠিন সময়েও আমরা নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর যে কোনো ক্ষয়ক্ষতিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছি। এবং তাদেরকে রক্তপাত থেকে সরে আসার কথা বলছি। দখলদারির শিকার সমস্ত পরিবার, আরব ও ইহুদীদের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি।’
ইসরাইলি আগ্রাসনে শুধু এবছরই ৪০ শিশু-সহ ২৪৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এখন জরুরি প্রশ্ন: ফিলিস্তিনিদের কি এই অবিরাম আগ্রাসন প্রতিহত করার অধিকার রয়েছে, প্রতিনিয়ত যার শিকার হচ্ছেন তারা? আছে, অবশ্যই রয়েছে। ঘটনা হলো ইসরাইল, ফিলিস্তিন উভয়ের মধ্যে নেই কোনো নৈতিক, রাজনৈতিক বা সামরিক সমতা। ইসরাইল একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। এমনকি কোনো নির্বোধও বলবে না তারা নিরাপত্তার হুমকির মুখে রয়েছে! নিরাপত্তার হুমকির মধ্যে রয়েছে আসলে ফিলিস্তিনিরা। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় নিরাপত্তার হুমকির মধ্যে তাদের ভূখ-, তাদের জীবন।
যখন ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করা হচ্ছে, তখন পাশে দাঁড়াচ্ছে ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা জেগে উঠছে নয়া ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে। সেকারণে, অবিলম্বে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ জরুরি। বন্ধ করতে হবে এই হামলা-পালটা হামলা। বন্ধ করতে হবে সংঘাত। ইতিমধ্যেই অনেক মৃত্যু হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়বে। এবং অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। ইসরাইলকে সমস্ত অবৈধ বসতি, ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডের দখলদারি প্রত্যাহার করতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বাস্তবায়ন করতে হবে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান সূত্র।
লেখকঃ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআইএম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তাত্ত্বিক পত্রিকা ‘মার্কসবাদী পথ’-এর সহযোগি সম্পাদক।