Saturday,7,December,2024
21 C
Dhaka
Saturday, December 7, 2024
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতউন্নয়নের সুফল হোক সমবন্টন

উন্নয়নের সুফল হোক সমবন্টন

।। আব্দুর রউফ ।।

প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। এর সমর্থক শব্দের মধ্যে রয়েছে বিবর্তন,বৃদ্ধি,প্রসরণ,বিস্তৃতি, প্রগতি,উত্তরণ ও বিকাশ ইত্যাদি। আবার এর বিপরীর্থক শব্দের মধ্য রয়েছে,প্রত্যাবৃত্তি,পশ্চাদগামন করা, প্রত্যাবর্তন করা ইত্যাদি। সাধারণ ভাবে উন্নয়ন বলতে বুঝায় কোন অগ্রগতি বা অগ্রসরমান ব্যবস্থা বা কোন কিছু বৃদ্ধি অথবা ব্যাপকতার ফল সরুপ  প্রাপ্ত হয়েছে। এক কথায় বলা যায়, উন্নয়ন হচ্ছে এক অবস্থা বা স্তর থেকে উন্নত বা কাঙ্খিত অবস্থায় উত্তোরণ। তবে অর্থনীতবীদ অমর্ত্য সেন মনে করেন কোন জাতি যদি কোন সময়ের জন্য উন্নত জীবনযাপন করে তবে তাকে উন্নয়ন বলা যাবে না। উন্নয়নের গূঢ় অর্থ হলো ইতিবাচক উন্নত উন্নয়নের স্থায়িত্ব। যেমন কোন দেশের সরকার যদি জনগণের মধ্যে পানির পাম্প বিতরণ করে তাহলে যতদিন বিতরণ করবে ততদিন তাদের পানির কোন অভাব থাকবে না। যখন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে তখন আবার তাদের দূর অবস্থা ফিরে আসবে। সুতরাং এ ধরণের বিতরণ বা সরবরাহ কোন ভাবেই উন্নয়নের সূচক নয়। এ জন্য তিনি অবস্থার স্থায়িত্বকে মূখ্য হিসেবে গণ্য করেছেন। যা জনগণের জীবনে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং সামাজিক-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জীবনে চলার প্রতিটি স্তরে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি  প্রভাব বিস্তার করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের একদম সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন না হয় তাহলে সেটাকে কোনভাবেই উন্নয়ন বলে গণ্য করা যাবে না। 

“উন্নয়ন ” শব্দটি এই সময়ের উচ্চরিত শব্দগুলোর মধ্য অন্যতম। তবে দেশের উন্নয়নের সুফল জনগণ কতটুকু ভোগ করছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। উন্নয়নের জন্য ব্যয় এবং উন্নয়ন থেকে প্রাপ্ত সুফল কতটুকু সর্বসাধারণ ভোগ করতে পারছে তার যুক্তিক দিক পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো করছে। আরও দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অকল্পনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রমাণ করে আমাদের দেশে এখন অনেক বড়লোক। যেমন গত কয়েকদিন আগে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে আকাশচুম্বী খরচ উন্নয়নে। ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। তিন বছরের প্রকল্পের মেয়াদ এখন ১৪ বছর। পত্রিকার এই শিরোনাম প্রমাণ করে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নয়নের মহা সড়কে অবস্থান করছে। সরকার শুধু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে। তবে দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দক্ষ প্রশাসন ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোনো দেশ দুর্নীতি, অশান্তি লালন করে টেকসই উন্নয়ন আশা করতে পারে না। দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তার ভিত্তি বা শিকড় যদি দৃঢ় না হয়, তবে একটা সময় তা ধসে পড়তে পারে। এ শঙ্কার কথা আবারও ব্যক্ত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)। সিপিডি বলেছে, বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের এখনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। তবে সবার জন্য শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রাথমিকভাবে সাফল্য এসেছে। এসডিজি অর্জনে সফল হতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জবাবদিহি এবং সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকগণ।

তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সত্যিই অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তবে যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে তার প্রভাব নিম্নআয়ের মানুষের উপরে পড়ছে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উন্নয়নের সুফল নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক মানুষ পাচ্ছে। তার চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে ধনীদের উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধির চিত্র দেখে। দেশে যখন বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় তখন দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার আমানতদারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৮২হাজার ৬২৫টি। অথচ গত সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮টিতে। অর্থাৎ ১এপ্রিল থেকে ৩০শে সেপটেম্বর, এই ছয় মাসে দেশে ব্যাংকে কোটি টাকা রাখার আমানতদারী সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তত্ত্বের বিবরণীতে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে অতি ধনী বৃদ্ধির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধ্বনি বৃদ্ধির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন কেউ পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। একদিকে যেমন দেশের ধ্বনির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে দারিদ্রতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু কোভিড-১৯ কালীন সময়ে প্রথম ৬মাসে দেশে শতাংশের দিক থেকে ধ্বনি বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় চলে গেছে। বর্তমান দেশে এরকম ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রমাণ করে দেশের উন্নয়নের সুফল সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের পাচ্ছে না। নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক মানুষ এই উন্নয়নের সুফলে নিজেদেরকে কোটিপতি বানিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে গরীব মানুষেরা আরো গরিব এ পরিণত হচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশের এই ক্রমবর্ধমান ধনী-গরিবের বৈষম্য স্বীকার না করলেও একসময় তা যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনাকালীন সময়ে দেশের অনেক মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে চাকরীচ্যুত হয়েছে। অনেকেই বাসা ভাড়া না দিতে পেরে বাধ্য হয়ে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে পাড়ি জমিয়েছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ার সাথে সাথে দেশে ভ্রাম্যমান মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।  তাই দেশে এরকম ধনী গরিবের বৈষম্য অশনি সংকেত।

বারবার দাবি করা হচ্ছে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে অন্যান্য দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেন উন্নত দেশ বলতে, যে সকল দেশ তার নাগরিকদের মুক্ত ও নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তাসহ উপযুক্ত পরিবেশ, স্বাস্থ্যকর জীবন প্রদানে সক্ষম তাকে বোঝায়। সে ক্ষেত্রে একটি দেশের উন্নয়নের মানদন্ডের সূচক শুধু অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি সেই দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত হয়েছে তার উপর। সেই সাথে নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, ধর্ম ও লিঙ্গ নিরপেক্ষতা,পরিবেশের বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা, ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র ইত্যাদির উপর। এ ছাড়া মুদ্রামানের স্থিতিশীলতা, শিল্প খাতের পাশাপাশি, সেবাখাত ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদ উন্নত দেশের অন্যতম মাপকাঠি। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার হার ইত্যাদি সবকিছুই বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সেটি কি মানসম্মত? এই প্রশ্নটির উত্তর সবার জানা। 

নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতির পাশাপাশি দেশের জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, স্থায়ীভাবে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খুন গুম, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। যেদিন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক নিজের দেশে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ মনে করবেন, যেদিন আমার দেশের মা বোনেরা নিজেদেরকে একদম নিরাপদ মনে করবে, নিজের বাকস্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা পাবেন, সেদিন নব্বই শতাংশ দেশ এমনি উন্নীত হবে। আমরা আশা করছি, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা, নারী নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে সরকার ব্যাপকভাবে এবং সঠিক উপায়ে কাজ করবে। শুধু লোক দেখানো নয়, সকল সমস্যার গোড়া থেকে সমস্যাগুলো নির্মূল করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবেই আমাদের বাংলাদেশ প্রকৃতভাবে উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারবে। আমাদের প্রত্যাশা, রূপকল্প ২০২১-২০৪১ পরিকল্পনা সফল হোক। বাংলাদেশের তার নাম উন্নত দেশের তালিকায় অবস্থান করে নেক। এ জন্য এখন থেকেই  কঠোর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার বাস্তবায় শুরু করা প্রয়োজন। তা না হলে উন্নত দেশ হওয়ার ‘রূপকল্প’  কল্পকথা হয়ে থাকবে। তাই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সেই বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সমতাভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে এই দেশের মানুষ উন্নয়নের সুফল সমভাবে ভোগ করতে পারবে। 

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
(নিবন্ধে প্রকাশিত অভিমত লেখকের একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। এটি সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে- সম্পাদক)

সর্বশেষ