নতুন কথা প্রতিবেদন ॥ ১৭ মে ঐক্য-সংগ্রাম ও গৌরবের ৫০ বছর পূর্ণ করবে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৯৭২ থেকে ২০২২-এই পঞ্চাশ বছরে দলটি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ এবং দুর্নীতি-লুটেরা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াইয়ে যেমন সাহসী ভূমিকা রেখেছে, তেমনি গরিব-মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবি মানুষের জীবন-জীবিকার সংকটেও প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল অবিরাম। একই সাথে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বামপন্থী দলগুলোকে এক কাতারে শামিল করে কমিউনিস্ট ঐক্যের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সমান তালে। ফলে ৫০ বছরে যেমন সুমহান অর্জন আছে, তেমনি লক্ষ্য পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানিও আছে। সুদীর্ঘ এই সময়ে দলটি যেমন এগিয়েছে, তেমনি পিছিয়েছে।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর পর থেকে আজ অবধি ওয়ার্কার্স পার্টি বৈষম্য-বঞ্চনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে সমতা, ন্যায্যতা ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর লড়াইয়েই আছে এটাই ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতির মূল লক্ষ্য। কারণ এ পার্টি গণমানুষের পার্টি, সংগ্রামের পার্টি। মহামারী করোনায় রাজশাহীতে শহীদ জামিল ব্রিগেড, ঢাকায় শহীদ রাসেল ব্রিগেড’সহ দেশজুড়ে ব্রিগেডের লাল বাহিনী প্রমাণ করেছে ওয়ার্কার্স পার্টি সংগ্রামেও আছে, সংকটেও আছে। সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম থেকে উগ্রসাম্প্রদায়িক জামাত-বিএনপি’র জোটের দুঃশাসন-প্রতিটি লড়াইয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি রাজনীতির বাঁকে বাঁকে সময়ের প্রয়োজনে সঠিক রণনীতি-রণকৌশল নিয়ে লড়াইয়ে থেকেছে সামনের সারিতে। ওয়ার্কার্স পার্টি তার প্রমাণ দিয়েছে নব্বইয়ের সামরিক এরশাদ বিরোধী গণঅভূত্থানে, বিএনপি-জামাত জোট বিরোধী সংগ্রামে। আপোসহীন সংগ্রামে আন্দোলনে পালন করেছে নিয়ামক ভূমিকা। লড়াইয়ের ময়দানে সেদিন ওয়ার্কার্স পার্টি’ই প্রথম বলেছিল,“বিএনপি-জামাত জোট সরকার আর না।” আবার আগুন সন্ত্রাস প্রতিরোধ করে দেশের সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে ২০১৪’তেও সঠিক রণকৌশল নিয়েই এগিয়েছে। আসছে ১৭ মার্চ জনগণের সংগ্রামের পরীক্ষিত সেই দলের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। পঞ্চাশ বছরের নবযাত্রায় ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিজ্ঞা উন্নত সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
জানাগেছে, স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ সংহত করে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে অসম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের কাজে উদ্যোগী হয়ে বহুধাবিভক্ত বাম কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোকে একত্রিত করে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পুর্নগঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। বহুবিধ বিভক্তি ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে সেই দলটি’ই এখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নামে এগিয়ে চলছে।
এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় লেনিনবাদী পার্টি যেমন বিভক্তির মুখে পড়েছে, তেমনি বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত বাম কমিউনিস্ট অন্যান্য গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। অবশেষে ১৯৯২ সালের মে মাসে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে সংগঠিত হয়ে এক নতুন পথের উন্মোচন করে। তবে বিভক্তির ধারা শেষ হয় নাই। এর মাঝেও পার্টি থেকে বেশ কিছু কমরেড আদর্শের নামে, কৌশলের ভিন্নতার নামে বেরিয়ে গেছেন এবং শেষ অব্দি তাদের বড় অংশ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, যার সাথে যে কোনো প্রকার ঐক্য তারা বিরোধীতা করেছে, তারই মাঝে নিজেদের বিলীন করেছে। অন্যরা বিপ্লবের নামে, বাম কমিউনিস্টের নামে নিজেরা অবস্থান করলেও, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাদের রাজনীতিও ডানপন্থার সাথে বিলীন হতে চলেছে।
এর মাঝ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পার্টি কমরেডদের মতাদর্শগত অবস্থান, সাংগঠনিক শৃংখলা ও ঐক্য। একে মোকাবিলা করে নিরন্তর অন্ত:পার্টি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্টিকে মতাদর্শগতভাবে দৃঢ়, সাংগঠনিকভাবে সুশৃংখল ও সর্বোপরি শ্রেণী ও গণসংগ্রামের উপযুক্ত অগ্রগামী বাহিনী হিসাবে দলটি এগিয়ে চলছে দেশের ভবিষ্যত বিপ্লবী পরিবর্তনের পথে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুমহান উত্তরাধিকার বহন করে। সাতচল্লিশে ভারত বিভক্ত হলে নতুন বাস্তবতায় পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নামে পার্টি পুনর্গঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে দুস্তর ফারাকের কারণে পাকিস্তান ভিত্তিক কাজ পরিচালনা সম্ভব না হওয়ায় পকিস্তানের পূর্ব অংশে পার্টি ‘পূর্ব পকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে সংগঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম যুগে ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের আন্দোলন, স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলনের এবং বিশেষভাবে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দলটি নিরলস প্রয়াসে এ দেশের যুব ও মধ্যবিত্তদের সংগঠিত করে সুমহান সব আন্দোলনের সূচনা করে।
পাকিস্তানের সর্বসময়ে পার্টি শাসক সরকারের চরম নিপীড়নের মুখে অধিকাংশ সময় গোপনে কাজ পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি শাসনামলে পার্টির নেতা কর্মীদের দিনের পর দিন কারাবন্দী থাকতে হয়েছে, জেলে অমানুসিক নিপীড়ন, এমনকি হত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১৯৫০ এ রাজশাহীতে এই কমিউনিস্টদের উপরই প্রথম জেল হত্যা সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক বন্দীদের মর্যাদার দাবিতে জেলে অনশন ও মৃত্যুর মোকাবিলা করতে হয়।
কিন্তু গণতন্ত্র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতা ও পূর্ব বাংলার মানুষের স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্নে পার্টির ঐতিহাসিক ভূমিকা বর্তমানে বিস্মৃত করে দেয়া হলেও ইতিহাসের সত্য হিসাবে তা সমুজ্জল থাকবে চিরকাল।
ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিবর্তন ঘটলে এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও আন্তঃপার্টি সংগ্রাম নতুন রূপ নেয়। ’৬৭-তে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পিকিং-মস্কো মহাবিতর্কের ধারায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়। কেবল এই আন্তর্জাতিক বিতর্কই নয়, অভ্যন্তরীণ কারণ, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার স্বীয় বাস্তবতা, বিপ্লবের স্তর, অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক প্রশ্নও এই বিভক্তিতে কাজ করে।
কিন্তু এই বিভক্তি এখানেই থেমে থাকে নাই। ভারতের নক্সালবাড়ী আন্দোলন ও চীনের সংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিভক্ত হয়ে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) কয়েকটি উপ-ধারায় বিভক্ত হয়। এই পার্টি জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার রণনীতি তুলে ধরলেও, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তার বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধকে রুশ-ভারত সাম্রাজ্যবাদীদের ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ হিসাবে অভিহিত করে। তার পূর্বেই ভারতের নক্সাল আন্দোলনের প্রভাবে পার্টি গণ আন্দোলন ও গণসংগঠনের পথ পরিহার করে শ্রেণী শত্রু খতমের রাজনীতি গ্রহণ করে।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি অপর ধারাগুলো ভারতের নক্সাল আন্দোলন ও চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবীবের দ্বারা প্রভাবিত থাকলেও, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে ১৯৭০ সনেই ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের লক্ষ্য ঘোষণা করে এবং সশন্ত্র সংগ্রামের পথে ঐ স্বাধীনতা অর্জনের পথ নেয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই উপধারায় কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো মওলানা ভাসানীর ন্যাপকে নিয়ে তাঁর অনুপস্থিততে তাঁকে প্রধান করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে মুক্তঞ্চল গঠন করে। এই ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে সহযোগিতার নীতি ঘোষণা করলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ভারত সরকার ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বৈরীতার মুখে লড়াই অব্যহত রাখতে হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পার্টির এই অংশের কাছে পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা ও পুনর্গঠিত করার কাজটি প্রধান হিসাবে সামনে আসে। সেই ধারাবাহিকতা জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি কমিউনিস্ট গ্রুপ মিলে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)’।
পার্টির এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় পার্টিকে ডান ও বাম-অতিবাম উভয় দিক দিয়ে চরম বিরোধীতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি চীন পন্থার বিরোধীতার নামে আদর্শ গত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে তাদের প্রচার কেবল নয়, শাসক বুর্জোয়াদলের পক্ষ নিয়ে নিপীড়নও চালিয়েছে। অপরদিকে চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল) বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করতে থাকে। তাদের শ্রেণী শত্রু খতমের কৌশল ও বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের অস্বিকৃতী তাদের জনগণ ও পার্টি কমরেডদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐ পার্টি ও কৌশলের প্রশ্নে নতুন নতুন ভাগ বিভক্তিতে পরে।
এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এই গ্রুপগুলোকে ক্রমশ নিকটবর্তী করে এবং ১৯৯২ এর ৪ঠা মে এক ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
তারপরও বিভক্তির ধারা কাটেনি। বিভিন্ন সময় কিছু কমরেড আদর্শ ও কৌশলের প্রশ্নে বিরোধীতা করে পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু পার্টি ঐ ঐক্যের ধারায় এখনো সংঘবদ্ধ আছে। বিভিন্ন বিভক্তি, আন্দোলনের ব্যর্থতা, মতাদর্শিক অবনতি, সাংগঠনিক শৃংখলার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব এবং বিশেষ করে নব্বইয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের পর ব্যক্তিগত লাভ, সুবিধা, অর্থনীতিবাদ, পার্লামেন্টারীবাদ, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মাশ্রয়ী চিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ পার্টিকে আকীর্ণ করে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে।
দলটির শীর্ষনেতাদের মাধ্যমে জানাগেছে, ৫০ বছর পূর্তিতে ওয়ার্কার্স পার্টি এ সকল প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিজেকে গড়ে তুলবে।
দলটির নেতারা বলছেন, এই মুহূর্তের কাজ হিসাবে ২১ দফা কর্মসূচীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে তাকে এগিয়ে নিতে ওয়ার্কার্স পার্টি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবে। ওয়ার্কার্স পার্টি আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে উন্নত সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক বাংলাদেশে।