।। এ্যাড. আশরাফ আলী ।।
শিক্ষা পদ্ধতি ও ব্যবস্থা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ কওমী শিক্ষার জন্য কওমী মাদ্রাসা বোর্ড গঠন করে পৃথক সুযোগ দেওয়ার কারণে আজ যে আজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও উগ্রধর্মীয় মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমানের সনদ প্রদান করে সরকার নীতিগতভাবে কওমী শিক্ষাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। কোনো শিক্ষা পদ্ধতির সরকারি স্বীকৃতি প্রদান দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই শিক্ষা ব্যবস্থা যখন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে নিজেদের মতো পরিচালনা করে এবং সেখানে কি ধরণের শিক্ষা প্রদান করা হয় তা জানার ব্যবস্থা না থাকে, বিপত্তিটা সেখানেই। কওমী শিক্ষা ব্যস্থায় এ কারণেই সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীতার উৎসে পরিণত হয়েছে। কওমী মাদ্রাসায় কোরআন ও সুন্নাহর বাইরে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না, এই কথাটি সত্য এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেকোনো শিক্ষা পদ্ধতি অনুমোদনের ক্ষেত্রে জাতিসত্ত্বা রাষ্ট্রের অধীনে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কওমী মাদ্রাসাগুলো জাতিসত্ত্বা আদৌ স্বীকার করে কি না তা আজকে রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাখিল, আলীম, ফাজিলসহ কামিল মাদ্রাসাগুলো কোনোভাবেই ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা নয়। এই ধরণের মাদ্রাসায় যদি বাংলা সাহিত্য, আরবি সাহিত্য, বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে কওমী মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা, আরবি, ইংরেজি, পারস্য সাহিত্যসহ বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার পাঠদানও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মাদ্রাসাগুলোকে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করে বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু না করলে উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় মতবাদের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা রোধ করা যাবে না। যে মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের লেখা, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করালে, জাতীয় সংগীত হলে ধর্মের অবমাননা হবে এমন দাবি করা হয়-তারা কোন শিক্ষা অর্জন করছে তার একটা জরিপ পরিচালনা করা দরকার।
কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারা বিশেষ ভূমিকা রাখে তাদের সম্পর্কে জরিপ করলে সহজেই বুঝা যাবে তারা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা নয়। কওমী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠাতাগণ মিশরের আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যায়ন করা। এদেশের সাম্প্রায়িক ও ধর্মীয় উগ্রবাদের একটা অংশ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিশরের আজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের সন্তানদেরকে প্রেরণ করে। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে একটা সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে আজকে হেফাজতে ইসলাম নাম দিয়ে এদেশকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উর্বর মাঠ হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সরকারের আপোসকামী নীতির কারণেই কওমী মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সংগীত পাঠ করা হয় না। জাতীয় সংগীত পাঠ না করেই তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। এর ফলে তাদের মধ্যে কোনো দেশাত্ববোধ তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে সাহিত্য, সমাজ, সভ্যতা পরিবেশ এবং বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠদান না থাকায় তাদের জ্ঞানের পরিধির বিকাশ হচ্ছে না। যা শেখানো হচ্ছে তাতে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আর কিছুই শিখছে না।
মিশরের আজাহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা অর্জন করে আজাহারী উপাধি ব্যবহারকারীদের মূল লক্ষ্য এদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি। কোনো ইসলামের মূলনীতি বা কোরআন সুন্নাহ্ মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, মূল উদ্দেশ্য ধর্মের আবরণে বাংলাদেশকে তালেবানি কায়দায় পরিচালনা করা। ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত শিক্ষা এবং কোরআন সুন্নাহ্ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটা শিক্ষাবোর্ড একটি করলে আজকে অন্তত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা এতটা বেশি হতো না। কওমী মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি হেফাজতে ইসলাম চাপ প্রয়োগ করেছে। তাদের কথামতো করোনার কারণে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না হলেও কওমী মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া হয়। সারাদেশে সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর শতকরা ৫ ভাগ শিক্ষার্থীও কওমী মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করে না। অথচ করোনাকালীন সময়ে কওমী মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া হলো। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। করোনা রোগে কে আক্রান্ত হবে এবং কে আক্রান্ত হবে না, সেটা বলা মুশকিল। তার পরেও সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুলে এসব মাদ্রাসা খোলার অনুমতি প্রদান বৈষম্য ছাড়া আর কী হতে পারে? কওমী মাদরাসাগুলো মাদরাসা বোর্ডের মান-মর্যাদা ও সমশিক্ষা ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে জাতীয় সংগীত যেমন অপরিহার্য, তেমনি নজরুল সাহিত্য, রবীন্দ্রসাহিত্য, পারস্য সাহিত্যসহ বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রভূমি তৈরি করা অতীব জরুরি। কওমী মাদরাসাগুলোতে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি না করলে উর্বর সাম্প্রদায়িকতা এদেশকে দখল করে নেবে সন্দেহ নাই। আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ডিগ্রী অর্জন করে এদেশে কওমী শিক্ষার উত্থান সৃষ্টি করেছে, একদিন হয়তো সেই আজহার বশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সাম্প্র্রদায়িকতার উষ্কানি দিয়ে এদেশের জনগণকে ভুলভাবে পরিচালিত করবে। শক্তি অর্জন করে একদিন তারা রাষ্ট্রটাই দখল করতে চাইবে। তারা রাষ্ট্রের জন্যই হুমকি হবে। অতএব এখনো সময় আছে কওমী শিক্ষা ব্যবস্থা ও মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আনাটা একান্ত জরুরি।
লেখক: সদস্য, বাংলাদেশর ওয়ার্কার্স পার্টি, গাইবান্ধা জেলা কমিটি।