নতুন কথা প্রতিবেদন: দেশজুড়ে চলছে কঠোর লকডাউন। ইতোমধ্যে তা আরো ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে কঠোর লকডাউনেও খোলা রাখা হয়েছে শিল্পকারখানা ও ব্যাংক। জরুরি সেবাদান প্রতিষ্ঠান তো খোলা রাখতেই হবে। এরই মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল থেকে দোকানপাট খোলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাঁকি আছে কেবল গণপরিবহণ। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা নেই। আগের মতোই রাজধানীতে যানজটের দৃশ্য চোখে পড়ছে। প্রথম দু’/একদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হলেও এখন তারাও গাছাড়া দিয়েছে। ফলে কঠোর লকডাউনও আগের মতোই ঢিলেঢালা। উপেক্ষিত আসল উদ্দেশ্য। মরণ কেবল গরিব-মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের। তারা উপার্জনের অভাবে সীমাহীন কষ্টে আছেন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন রাজধানীসহ দেশের ফুটপাতের লাখো হকাররা। একদিকে আয়ের পথ বন্ধ, অন্যদিকে বাসাভাড়া ও নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে চিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও। বিশ্লেষকরা বলছেন, লকডাউন-লকডাউন খেলা না খেলে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে প্রকৃত অর্থেই সকল কিছু বন্ধ করতে হবে। শ্রমজীবী মানুষকে সাহায্য করে সকলকে লকডাউন মানার ব্যবস্থা করতে হবে। তানাহলে এই লকডাউনে আসল লক্ষ্য পূরণ হবে না।
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও সারাদেশের প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ থেকে জানাগেছে, রাজধানীর অলিগলি ও ফুটপাতে মানুষের জটলা দেখে মনেই হচ্ছে না, লকডাউন বলে কিছু চলছে। বরং এই লকডাউনেও মানুষের বাইরে আসার ধুম পড়েছে। একেবারে প্রয়োজন নেই-তা বলা যাবে না। তবে কেউ বের হচ্ছে জরুরি প্রয়োজন ও পেটের দায়ে, আবার কেউ অকারণে। কঠোর লকডাউনেও খোলা রাখা হয়েছে ব্যাংক ও শিল্পকারখানা। খোলা জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান। ফলে কঠোরতার মধ্যেও মানুষ খুঁজছেন বাইরে বের হওয়ার ফাঁক। রাজধানীর সড়ক এখন ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। পেটের দায়ে রাস্তার দখল নিয়েছে গরিব রিকশাওয়ালা, সিএনজি, মোটরসাইকেল চালকেরাও। গণপরিবহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই চলছে আগের মতো। রাস্তায় পুলিশ আছে, তবে তারা বিত্তবান, ক্ষমতাধরদের ঠেলায় কাবু হয়ে বেশি ঝুঁকছে অসহায় রিকশা-ভ্যানওয়ালার দিকে। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া রাস্তায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে একজন চিকিৎসকের দাম্ভিকতা দৃশ্য যেমন দেখেছেন, তেমনি দু’জন অসহায় রিকশাওয়ালার ক্ষুধার জ্বালায় পুলিশের বাধার মুখে গগণবিদারী আর্তনাদও দেখেছেন। ক্ষমতার দাপটে চিকিৎসক পুলিশকে তুই-তুকারি করতেও দ্বিধা করেন নি। তাতে পুলিশ তাকে কিছুই বলতে পারেন নি, উল্টো চিকিৎসক তাকে ক্ষমতা চাইতে বলেছেন। অন্যদিকে অসহায় রিকশাওয়ালাকে ১২ শ’টাকা জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী রিকশাওয়ালাকে মারা হয়েছে। পেটের দায়ে বহু রিকশাওয়ালা পুলিশের মার খেয়েছেন, অকথ্য গালিগালাজ শুনেছেন তারপরেও রিকশা ছাড়তে চান নি। পেটের দায়ে রিকশা রক্ষার লড়াই করেছেন। লকডাউনের মধ্যেও ট্রাফিক পুলিশেরা আগের মতোই হাত উঠিয়ে সিগনাল দিচ্ছেন। বড়লোকের ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে ধুমিয়ে। সেখানে হাত জাগানোর সাহস না পেলেও গরিবের রিকশা উল্টিয়ে রাখা হয়েছে রাস্তায়। বাজারে যাবো, হাসপাতালে যাব, ব্যাংকে যাব, কারখানায় যাচ্ছি-ইত্যাদি নানা অজুহাতে রাস্তায় হাজারো মানুষের আনাগোনা। কাঁচাবাজারগুলোতে চলতে হচ্ছে মানুষের ভিড় টেলে। সেখানে সমস্যা নেই। কিন্তু কিস্তির জন্য, ছেলে-মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে রিকশা নিয়ে বের হলেই তার ওপর চলছে আইনের স্ট্রিম রোলার। বাধা দেওয়া হচ্ছে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালকদের। “যতো বাধা কেবল গরিবের বেলায়”-বলছেন হতভাগ্য রিকশাওয়ালারা। তারা বলছেন, “লকডাউন হলেও পেটের তো আর লকডাউন নেই। পরিবারের সদস্যদের মুখে তো আর তালা দিতে পারি না। ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানি বিল, গ্যাস বিল, কিস্তিওয়ালারা তো মাফ দেয় না। ফলে মৃত্যু আতঙ্ক হাতে নিয়েই আমাদের রাস্তায় বের হতে হয়।। আমরা রাস্তায় আসি পেটের দায়ে, সখের বশে নয়।” শ্রমজীবী এই মানুষগুলো একটাই কথা,“ করোনার চেয়েও আমাদের মহাতঙ্ক ক্ষুধা”। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। কারণ এখনো সরকারিভাবে শ্রমজীবীদের সাহায্যের কোনো পদক্ষেপ নেই।
কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়েছে ঠিকই, একই সাথে ৪০ লাখ মানুষের সমাগম হয় যে গার্মেন্টস কারখানায় তা খুলে রাখা হয়েছে। মালিকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গাড়ি দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে এসেও রাস্তায় এসব শ্রমিকের দুর্ভোগের সীমা থাকছে না। গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। শ্রমিক নেতারা বলছেন, গার্মেন্টস শ্রমিকরাও মানুষ। তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে সংক্রমণ প্রতিরোধে গার্মেন্টস বন্ধ রাখা উচিৎ। এই লকডাউনে কষ্টে আছেন বাসাবাড়িতে কাজ করা গৃহশ্রমিকরাও। এই সময়ে তাদের কাজ বন্ধ। বস্তির খুপরি ঘরে তারাও নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ফলে লকডাউনে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের। যাদের দিনআনি’তে ভরসা।
এই লকডাউনে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীর অলি-গলি ও পাড়া-মহল্লায় লোকে লোকারণ্য। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার পরেও রাস্তায় কিশোরের আনাগোনা। তরুণ বয়সী ছেলে-মেয়ে আড্ডা দিচ্ছে যত্রতত্র। ঘরে থাকছেন না বৃদ্ধরাও। রাজধানীর বাইরে অন্যান্য মহানগর ও মফস্বল শহরে এমন দৃশ্য আরো বেশি। আর উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলোতে তো করোনাকে তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। বরং কেউ সতর্ক করলে, উল্টো তাকেই তাচ্ছিল্য করা হয়। দেশের মানুষ যেভাবে চলাফেরা করছেন, তাতে বাংলাদেশ করোনা মহাঙ্কটে আছে এটা মোটেও বোঝার উপায় নেই। যে মানুষের মঙ্গলের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হলো, তারাই পঙ্গপালের মতো শহর ছেড়ে গ্রামে গেল। মনে হলো লকডাউন যেন ঈদ উৎসব!
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তা পরিকল্পিতভাবে করা দরকার। লকডাউনের আগে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষ কেমনে চলবে তা ভাবা দরকার। তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। এছাড়া লকডাউন দিলে সব ক্ষেত্রে তা দিতে হবে। এরকম লকডাউন লকডাউন খেলা খেললে আসল উদ্দেশ্য হাসিল তো হবেই না বরং গরিবের সংখ্যা বাড়বে। বাড়বে তাদের মানবেতর জীবনযাপন।