Thursday,5,December,2024
20 C
Dhaka
Thursday, December 5, 2024
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যকমরেড কাবুল অমর রহে

কমরেড কাবুল অমর রহে

॥ শ্যামল শর্মা ॥

শ্যামল শর্মা

পার্টি ও গণসংগঠনের এক নিবেদিত প্রাণের নাম কমরেড মোস্তাফিজুর রহমান কাবুল। সকলের কাছে পরিচিত প্রিয় কাবুল ভাই নামে। সদা ক্লিনশেভড, মার্জিত পোশাক, অল্পভাষী আর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরের এই মহান মানুষটি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। প্রকৃতির অমোঘ সত্য মৃত্যুর ডাকে তিনি সাড়া দিয়ে চলে গেছেন এক বছর আগে। গত ৩১ মে ছিল তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছরের এ দিনে এই বিপ্লবী অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
সাদাসিধে মনের কমরেড কাবুল সর্বদা শার্ট ইন করে পড়তেন। বেশিরভাগ দিন পার্টি অফিসে আসতেন সন্ধ্যা বেলায়। চেহারা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর মোটা গোফে ছিল কিছুটা জোসেফ স্টালিনের প্রতিচ্ছবি। তিনি কেবল সংসার, কর্ম ও রাজনীীত নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না। মাঝে মাঝে তার ক্ষুরধার লেখায় লেখায় উঠে আসতো বিপ্লবী চিন্তাধারা। মার্কসবাদ, লেলিনবাদের তিনি যেন এক জীবন্ত পাঠশালা। পার্টির প্রোগ্রামে তাৎক্ষণিক প্রেসলিরিজ লেখায় তার তুলনা ছিল না। পেশাদার সাংবাদিক না হলেও সংবাদ এবং সাংবাদিকতার প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার পরেও তার লেখা কবিতা ছিল অসাধারণ। অফিসে ছাত্র মৈত্রীর সহযোদ্ধা পেলেই শুরু করতেন স্বরচিত কবিতা আসর। গঠনমূলক বক্তৃতায় সবাই তার প্রশংসা করতেন। সোহাগি জাহান তনু হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে যশোরের দেড়াটানায় ছাত্র মৈত্রী ও যুব মৈত্রীর যৌথ প্রোগ্রাম। সেই প্রোগ্রামে ধীর গতিতে মটর সাইকেল নিয়ে আসা এক ভদ্রলোক সমাবেশের সভাপতির নির্দেশে তাকে মঞ্চে আহ্বান করলাম।
পরে তার বক্তব্য শুনেছিলাম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। মাঝে মাঝে রাশেদ ভাইয়ের সাথে তার কর্মস্থলে যেতাম। নানা উপদেশ বাণী শুনে ভাবতাম কি অমায়িক মানুষ কমরেড কাবুল ভাই।
যশোর জেলা ছাত্র মৈত্রী’র ১২তম সম্মেলনে আমি সভাপতি হলাম। একুশে ফেব্রুয়ারি সভাপতি হিসেবে আমি কমরেড কাবুলকে নিজের পরিচয় দিয়ে ফোন করতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো “কাল দেখা কর।” সংগঠনের জন্য চাঁদা সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথম সারির শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন কমরেড কাবুল। কেবল তাই নয়, সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে বলেছিলেন এতে সাংগঠনিক সকল বিষয় লিখবা। বড় কোনো কর্মসূচীতে বক্তৃতা করার আগে আমি কমরেড জাকির হোসেন হবি অথবা কমরেড কাবুলের কাছেই বেশি যেতাম। খুব অল্প কথায় দারুণ পয়েন্ট বলে দিতেন। কেবল তাই নয়, বহু আবদার নিয়ে কমরেড কাবুলের কাছে গিয়েছি, কিন্তু কখনো তার মুখ মলিন দেখি নাই। সব সময় হাসিখুশি থাকতেন।
মনিরামপুরের রাজগঞ্জের পার্টির প্রায়ত কমরেড দুলু ভাইয়ের স্মরণ সভার সময় আমার ঢাকায় সংগঠনের কাজে যাওয়ার তাড়া, কিন্তু কমরেড কাবুল ভাই ফোনে বললেন, “দুলু ভাইয়ের স্মরণ সভায় তোমরা কয়জন যাবা? তোমার কিন্তু সেখানে বক্তব্য দিতে হবে, প্রস্তু থেক।” কিছু না বলে ওই প্রোগ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সত্যি কথা তাকে ঢাকায় যাওয়ার তাড়ার কথা বলতেই পারি নাই। এমন নানা কাজে তার সংস্পর্শে যাবার সুযোগ হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার ভাল লাগতো যেকোনো জটিল সমস্যাকে কাবুল ভাই কেন জানি খুব সহজেই সামলে নিতেন। ছাত্র মৈত্রীর ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকিতে পার্টি অফিসের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন, একসাথে কেক কাটলাম। যশোর আর, এন রোডস্থ নান্নু চৌধুরী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট থেকে অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষাথীদের মাঝে বাৎসরিক বৃত্তি দেওয়া হয়। সময় এলেই তিনি আমাকে বলতেন তোমাদের কেউ থাকলে জানিও। এই কথাটা আর হয়তো কেউ বলবে না! যশোর ইন্সটিটিউট নির্বাচনে “পরিবর্তন ও উন্নয়ন সমিতি প্যানেলের” পক্ষের একজন অফিস সহকারী (বেতনভুক্ত) লাগবে। কমরেড কাবুল ফোনে বললেন, “তোমাদের ভেতর থেকে একজন বিশ্বস্ত ছেলে দাও।” জানি এই কথাটাও আর কেউ বলবে না। তার মতো একজন মানুষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কতটা ভাবতো তা অকল্পনীয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দেওয়া বিভিন্ন স্টাটাস দেখলে বোঝা যেত।
ওয়ার্কার্স পার্টি বিভক্ত হবে গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। যার প্রধান হট স্পট যশোর জেলা। বন্ধু সংগঠন ছাত্র মৈত্রী কোনো দিকে টার্ন নিবে একটা প্রশ্ন। অনেক কমরেডের মনে মুখে অনেক রকম কথা। শুনতে পেলাম কমরেড কাবুল পার্টির মূল ধারার সাথে থাকবেন। আর জেলার অধিকাংশ হেভিওয়েট নেতারা বেরিয়ে আসবেন। শুরু হলো টানাপোড়ন। অনেক নেতার ফোন রিসিভ করতে হলো ছাত্র মৈত্রীর কর্মীদের। আমাকেও অনেকে ফোন করতো জেলা কিংবা জেলার বাইরে থেকে। কিন্তু কমরেড কাবুল ভাই এ ব্যাপারে আমার কাছে কিছুই জানতে চান নি। বরং আমি নিজে থেকে কয়েকবার তাকে বলেছিলাম। উত্তরে বলেছিলেন, “তামার নিজস্ব বিবেচনা আছে তোমাকে বোঝনো বোকামি।” আর এখানেই তার প্রতি আমার ভালোলাগা-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আরো বহুগুন বেড়ে যায়। নতুন পার্টি অফিস হলে আমাকে বললেন, “নিয়মিত একটু পার্টি অফিসে বসো। যে কয়দিন আছ একটু গুছিয়ে দাও।”
কমরেড কাবুল ভাই আমি তো এখনো আছি। ফাঁকি দিয়ে তো আপনিই চলে গেলেন। কথা দিয়েছিলেন একসাথে পোস্টারিং করবেন। কিভাবে ভুলতে পারলেন আপনি। আপনার উপর বড্ড অভিমান হয়। এভাবে কেন চলে গেলেন। আপনার বাসায় যেতে আমাকে আর অরুপ মিত্রকে বলেছিলেন। বলেছিলেন, বই সংগ্রহের ব্যাপারে কথা বলবেন আর দুপুরে খাওয়াবেন। সংগঠনের ব্যস্ততার কারণে যেতে পারি সময়মতো যেতে না পারলেও, যখন গেলাম তখন আপনে নেই।
কমরেড কাবুল পার্টির ১০ম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় সদস্য পদ লাভ করেন। ছাত্র মৈত্রীর যশোর জেলার ইনচার্জের দায়িত্ব ভারটাও নেন নিজের কাঁধে। তাকে সাথে নিয়ে অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমাদের কিন্তু তা আর হলো না ।
তবে তিনি হতাশ হতে শেখান নি। আমরা একজন ছাত্রবান্ধব অভিভাবককে হারিয়েছি ঠিকই। তবে তার দেখানো পথে হাঁটতে শিখেছি। তিনি নেই তার দেখানো পথেই তার অসমাপ্ত লড়াই চালিয়ে যাব। দেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, সংগঠনের কর্মীদের প্রতি তার যে দায়বদ্ধতা ছিল তা আমৃত্যু পালন করে আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে মানুষের জন্য মানুষের সংগ্রামে থাকতে হয়। কমরেড কাবুল অমর রহে ! বিপ্লব ও বিপ্লবীদের মৃত্যু নাই। তুমি আছো, তুমি থাকবে-এদেশের শ্রমজীবি মানুষের শোষণমুক্তির লড়াইয়ে। প্রথম মৃত্যুবার্ষীকিতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাসহ লাল সালাম।
লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, যশোর জেলা কমিটি।

সর্বশেষ