সত্তর দশকে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ নগরে বাস করতো । বাকি ৯২ শতাংশ মানুষের বাস ছিল গ্রামে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ লোক নগরে এবং ৬০ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে।খরা-বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছাস, নদী ভাঙ্গনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ বাপ-দাদার চিরপরিচিত বাড়ি-ভিটা ত্যাগ করে একান্ত বেঁচে থাকার তাগিদে আশ্রয় নিচ্ছে শহরের বস্তিতে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে নগরবাসীর সংখ্যা। সেইসাথে বাড়ছে তাদের খাদ্য, পুষ্টি, বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপের তথ্যের প্রাক্কলন থেকে ২০১৯ সালে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। সে অনুয়ায়ী দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে জীবনযাপন করে। অপরদিকে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক জরিপ প্রাক্কলন থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে নতুন করে দেশের আড়াই কোটি মানুষের জীবনমান দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। ফলে সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যার অর্ধেকই রয়েছে নগরীয় এলাকায়।
বাংলাদেশের নগরগুলোতে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ রয়েছে , যাদের খাদ্য নিরাপত্তা নেই। নেই পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা। এইসব মানুষগুলো গ্রামের মানুষের মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুযোগও পাচ্ছে না। নগরের দরিদ্রদের মাত্র ১ শতাংশ টিসিবি বা ওএমএসে পণ্য কেনার সুযোগ পায়। বর্তমানে করোনার কষাঘাতে টিসিবি কিংবা ওএমএসের পণ্য কেনার মতো অর্থও তাদের হাতে নেই। করোনামহামারির প্রভাবে দেশের নগরগুলোতে দরিদ্রদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে লকডাউনের ফলে অনেকের কাজ নেই। হাজার হাজার দিনমজুরসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের আয় একেবারে কমে গেছে। অনেকের আয় নেমেছে শূন্যের কোটায়। দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল এইসব দরিদ্র পরিবারগুলো দিনের খাবার যোগার করতে হিমশিম খাচ্ছে। কাজ অথবা সরকারি সহায়তা ছাড়া তাদের বেঁচে থাকার উপায় নেই।
অবস্থা শোচনীয় হলেও এসব পরিবারের সরকারি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ কম বা নেই বললেই চলে। কারণ, সরকারি সহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই নেই নগরের সিংহভাগ দরিদ্র পরিবার। নগরের দরিদ্রদের অধিকাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কোনো তালিকাতেই অন্তর্ভুক্ত নয়। নগরে বাস করলেও ভোটার তালিকায় অন্তভর্ৃূক্ত না থাকায় সিটিকরপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব দরিদ্র পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা হয় না। আবার গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস না করার ফলে সেখানেও তালিকাভুক্ত হতে পারে না তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুু পরিবর্তনের কারণে দেশের বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। দিনমজুর, হকারি, রিকসা, ঠেলাগাড়ি চালনো, নির্মাণ কাজ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় শ্রমিকের কাজ ও ক্ষুদ্র ব্যবসাই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। লকডাউনের কারণে এধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ একবারে কমে গেছে। ফলে তারা খাবারও কম খাচ্ছে। অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে অথবা অন্য শহরে চলে গেছে। এই ধরনের পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দ্রæত খাদ্য সহায়তা দেওয়া দরকার।
দেশের নগরীয় এলাকায় বর্তমানে ৩০ মিলিয়ন দরিদ্র জনগোষ্ঠির বসবাস । বিগত পাঁচ দশকের কম সময়ে দারিদ্র্য মাত্রা ৭০ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে হ্রাস বাংলাদেশের জন্য একটি অনন্য অর্জন ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দারিদ্র্য একটি অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা এবং এটি জাতীয় উন্নয়নে বাঁধার সৃষ্টি করে। এজন্য সরকার বৃহৎ পরিসরে বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্য দূরিকরণের নীতি গ্রহণ করেছে। দাতাগোষ্ঠি ও সরকারের এসব নীতি ও কর্মসূচি সমর্থন দিচ্ছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ উল্লেখযোগ্য। এধরণের কর্মসূচি নগরীয় এলাকায় দেখা যায় না। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা সমূহের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে নগরীয় দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি যতটুকু দরকার এখনও ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। তবে আশার কথা- বর্তমানে নগরীয় দারিদ্র্য দূরিকরণে কর্মসূচি বা নগর দরিদ্রদের বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে গম্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিভিন্ন ফোরামে জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।
বিসিএসের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিক সংকটের পড়লে ৩৯ শতাংশ মানুষ খাবার বাবদ ব্যয় কমিয়ে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। সংকটে বাড়লে ২২ শতাংশ পরিবার কম খাবার খায়। আবার ১৭ শতাংশ পরিবার নি¤œ মানের খাবার গ্রহণ করে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী নগর অঞ্চলে খাবার নেই, আবার খাবার কেনার টাকাও নেই এমন মানুষের হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। অন্যদিকে এক বেলা খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় ৮ দশমিক ২২ শতাংশ নগরবাসী। দেখা গেছে দুর্যোগে ২০ শতাংশের বেশি মানুষ তেমন কিছুই করে না। তাছাড়া সঞ্চয় ভেঙ্গে, ঋণ করে বা অন্যদের সহায়তা নিয়ে অনেকে সংকট মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। তবে বছরে বেশি সময় ধরে চলমান সংকটে অনেকেই সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সহায়তাও কমে আসছে। এর ফলে খাবারের কাটছাঁট করা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
অঞ্চল ও পেশার বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা ১০ শ্রেণির মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, প্রায় ৮১ শতাংশ পরিবার করোনার কারণে খাদ্য ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। আয় কমে যাওয়া বস্তিবাসী খাবার কেনায় এখন ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ কম ব্যয় করে। দুই শতাংশের বেশি মানুষ মাসে অন্তত একদিন এক বেলাও খাবার পায় না। করোনায় আয়-উপার্জন হারিয়ে পুষ্টিকর খাবারে জোগান নিয়ে দুর্ভাবনায় এখন লাখ লাখ মানুষ। খাবারের বৈচিত্র ও পরিমাণ কমে যাওয়ায় পুষ্টি পরিস্থিতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের। দীর্ঘদিন কম খেয়ে থাকার কারণে অপুষ্টির শিকার লোকজন আর আগের মতো কাজ করার শক্তি পাবে না। এর ফলে করোনা সংক্রমণ কমে গেলেও জাতীয় উৎপাদনশীলতা পূর্বের অবস্থায় ফেরা সম্ভব হবে না। পুষ্টির অভাবে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হলে এর প্রভাব আগামী প্রজন্মেও পৌঁছাবে।
দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যে অবকাঠামো রয়েছে ,তাতে কয়েকটি কর্মসূচি ছাড়া বাকি সব গ্রাম কেন্দ্রিক। ফলে নগরের দরিদ্ররা অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বলয়ের বাইরে রয়েছে। বর্তমানে করোনার প্রেক্ষিতে শুধু শহরের জন্য আলাদা কর্মসূচি চালু করতে হবে । অথবা গ্রামে চালু থাকা যেসব কর্মসূচি দারিদ্র বিমোচনে প্রশংসনীয় অবদান রাখছে সেগুলো নগরীয় এলাকায় বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে যেটাই করা হোক তা করতে হবে তাড়াতাড়ি এবং দ্রæততার সাথে।
নগরীয় দারিদ্র্য দূরীকরণের সাথে নগর দরিদ্রদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নগর দরিদ্ররা প্রধানত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কাজে নিয়োজিত। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অদক্ষ শ্রমিকদের বেতন কম, যা নিয়ে তারা মোটেও সন্তুষ্ট নয়। এ সমস্যা সমাধানে তাদের কারিগরী জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ঋণ প্রাপ্তির অপ্রতুলতার জন্য নগর দরিদ্ররা তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে না বা আয় বৃদ্ধির জন্য কোনো কর্মকাÐে নিয়োজিত হতে পারে না। বিপুল সংখ্যক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা গ্রামীণ দরিদ্রদের যতেষ্ট পরিমাণে ঋণ সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু নগর দরিদ্রদের জন্য এ সুযোগ খুবই সীমিত। নগর দরিদ্রদের মধ্যে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নগরীয় এলাকার আশেপাশে স্থাপিত বিভিন্ন অর্থনৈতি অঞ্চলের শিল্প কারখানায় নগর দরিদ্র্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য সামাজিক শ্রেণি ও গোষ্ঠির মতো নগর দরিদ্ররাও নগরের সমন্বিত অংশ। কাজেই একইভাবে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি, বাসস্থান, পরিবহন, পানি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন যেমন; চিত্তবিনোদন, খেলাধূলা ও নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। নগর দরিদ্রদের জন্য পৃথক ডাটাবেজ তৈরি করে নগরীয় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে করোনা কালে নগদ প্রণোদনা প্রদান করতে হবে।
বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ নগরে বসবাস করে। জনসংখ্যার এই বিরাট অংশকে কৃষি কাজের বাইরে রেখে নগরবাসীর খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তাই দেশের প্রতিটি নগর ও তার আশেপাশে নগরীয় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে , দেশের মাটি ও আবাহওয়া উপযোগী গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে ।
লেখকঃনিতাই চন্দ্র রায়,সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি),বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।