আন্তর্জাতিক ডেস্ক:প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার সব দেশে সাধারণত যে প্রার্থী বেশি ভোট পান তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ব্যতিক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে। দেশটিতে বেশি ভোট পেলেই প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। কারণযুক্তরাষ্ট্রে জনগণের সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। এই দেশে ইলেক্টোরাল কলেজ নামে পরিচিত একদল কর্মকর্তার পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট।
‘কলেজ’ শব্দটি বলতে একদল লোককে বোঝায়; যারা নির্বাচকের ভ‚মিকা পালন করেন। তাদের কাজ প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকরা। প্রত্যেক চার বছর অন্তর, নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ পরে ইলেক্টোরাল কলেজের নির্বাচকরা একত্রিত হন তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী এই পদ্ধতিতেই একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; যা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের আইনের জটিল এক সমন্বয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।
কীভাবে কাজ করে ইলেক্টোরাল কলেজ : ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি রাজ্যের হাতেই থাকে কিছু ভোট। কোন রাজ্যের কতজন ইলেক্টোরাল বা নির্বাচক থাকবেন তা নির্ভর করে ওই রাজ্যের জনসংখ্যার ওপর। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে। ফলে এই রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটারের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৫৫। ছোট ছোট কিছু রাজ্য এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার আছে তিনটি করে ভোট। আলাস্কা এবং নর্থ ড্যাকোটা রাজ্যের হাতেও তিনটি করে ভোট আছে।প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন প্রার্থীরা সারা দেশে ভোটারদের কাছ থেকে ভোট পান। সেগুলোকে বলা হয় পপুলার ভোট এবং ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটকে বলা হয় ইলেক্টোরাল ভোট। কোনো একটি রাজ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাবেন তিনি ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে যাবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, টেক্সাস রাজ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী যদি ৫০.১ শতাংশ ভোট পান, তাহলে ওই রাজ্যের ৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোট তার পকেটেই যাবে।
ইলেক্টোরাল কলেজে মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলেক্টোরাল কলেজে ভোট ৫৩৮টি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য এর অর্ধেক অর্থাৎ ২৬৯টির বেশি ভোট পেতে হবে। কোনো প্রার্থী ২৭০টি ভোট পেলেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন।
একেক রাজ্যের হাতে একেক সংখ্যক ভোট থাকার কারণে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারে এমনভাবে ছক তৈরি করেন যেখানে তারা বেশি ভোট আছে এমন রাজ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। গত পাঁচটি নির্বাচনের মধ্যে দুটোতেই কম পপুলার ভোট পেয়ে ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ড নির্বাচিত হয়েছেন।সর্বশেষ ২০১৬ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ কম পপুলার ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
কেন এই জটিল পদ্ধতি? : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন দেশটির বিশাল আকার ও বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ কঠিন হওয়ার কারণে জাতীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা প্রায় অসম্ভ ছিলো। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয় ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি। অঙ্গরাজ্যগুলোও তাদের নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে ছিলো অনেক বেশি সোচ্চার। রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো এবং পপুলার ভোটকে মানুষ ভয় পেতো।
একারণে ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুটো ধারণাই বাতিল করে দেয়া হয়। সংবিধান প্রণেতাদের যুক্তি ছিল পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লোকেরা তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।
ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি সমর্থন করে। কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয়। কারণ সে সময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিলো অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকলেও আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হতো।এছাড়া সংবিধান রচয়িতারা চাননি যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।
মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাস ঘেটে দেখ যায়, ১৮০৪ সালের পর পাঁচজন প্রেসিডেন্ড পপুলার ভোট বেশি না পেয়েও নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগে ২০০০ সালের নির্বাচনে আল গোর সারা দেশের মোট ভোটের ৪৮.৩৮ শতাংশ ভোট পান। জর্জ বুশ পান ৪৭.৮৭ শতাংশ। তারপরও জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কারণ তিনি ২৭১টি ইলেকটোরাল ভোট পান; যেখানে গোর পান ২৬৬টি। জয় নির্ধারণী ইলেক্টোরাল ভোটগুলো এসেছিল ফ্লোরিডা থেকে। সেখানকার ২৫টি ইলেক্টোরাল ভোটই গেছে জর্জ বুশের দিকে; যদিও তিনি ওই রাজ্যে মাত্র ৫৩৭টি পপুলার ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো অনেক রাজ্যেই ফলাফল কী হবে সেটা আগে থেকে নিশ্চিত করে বোঝা যায়। ফলে অনেকে ভোট দেয়ার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে প্রচার চালিয়ে তাদের সময় নষ্ট করতে চান না।উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে ক্যালিফোর্নিয়া, ইলিনয় এবং নিউইয়র্ক ডেমোক্র্যাটের এবং টেক্সাস রাজ্যটি রিপাবলিকানদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
এর সুবিধা কী : ঐতিহাসিক কারণে এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিকে এতোটা গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়াও বেশিরভাগ নির্বাচনে পপুলার ভোটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে। ১৮০৪ সালের পর ৫৩টি নির্বাচনে ৪৮জনই নির্বাচিত হয়েছেন পপুলার ভোটে।এছাড়াও এই পদ্ধতিতে ছোট রাজ্যগুলো গুরুত্ব পায়। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের একটি মৌলিক নীতি ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সও’ রক্ষিত হয়।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বৃহত্তর রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১২.০৩ শতাংশ। কিন্তু এই রাজ্যের হাতে আছে ৫৫টি ইলেক্টোরাল ভোট যা ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের ১০.২২ শাতংশ।অন্যদিকে ওয়াওমিং রাজ্যের লোকসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ০.১৮ শতাংশ। কিন্তু তাদের হাতে আছে তিনটি ইলেক্টোরাল ভোট যা ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের ০.৫৬ শতাংশ।এই কলেজ সিস্টেমের আরও একটি দিক হচ্ছে একজন প্রার্থীকে সারা দেশে ভোট পেতে হবে।
কোন প্রার্থী ইলেক্টোরাল কলেজের ২৭০টি ভোট না পেলে কী হবে? : সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী অনুসারে হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে থাকে।প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধির হাতে থাকে একটি করে ভোট। তার মানে প্রত্যেক রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এই ভোট নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে জিততে হবে।