।। নিতাই চন্দ্র রায় ।।
১.ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে। ২. কৃষক প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণে কৃষি পণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে। ৩. ইউনিয়ন পর্যায়ে খাদ্য গুদাম নির্মাণ করতে হবে। ৪. কৃষকদের বাঁচাতে অবিলম্বে কৃষি বীমা চালু করতে হবে ৫. ষাটোর্ধ্ব কৃষকদের পেনশন চালু এবং ক্ষেতমজুরদের সারা বছর কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ৬. সারা দেশের জেলা, উপজেলা ও পৌরশহরগুলোতে কৃষক বাজার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৭. কৃষিপণ্য বিপণন প্রক্রিয়ায় মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। ৮. এলাকায় এলাকায় কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলা এবং বন্ধকৃত কৃষি ভিত্তিক সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে। ৯. কৃষি জমির আশেপাশে ইটভাটা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ১০. কৃষি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বাজেট বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে।
যেকানো দেশের উন্নয়নকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করলে কৃষি তার মূল, শিল্প তার শাখা আর বাণিজ্য তার পাতা। মূলে পচন ধরলে শাখা শুকিয়ে যায়। পাতা ঝড়ে পড়ে, ধীরে ধীরে বৃক্ষটির অপমৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই প্রবাদটির তাৎপর্য সমভাবে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ এখনো কৃষি প্রধান দেশ। সাড়ে ষোল কোটি মানুষের খাদ্য, পুষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যার প্রায় ৪১ ভাগ এখনো কৃষির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩.৬ শতাংশ। পাট ,চিনি, চা, বস্ত্র, চামড়াসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের যোগান দাতাও কৃষি। কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে-কৃষির অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯৭১ সালে মার্কিনীদের দেয়া তলাবিহীন ঝুরি অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বের বিস্ময়। কৃষি উন্নয়নের অনন্য উদাহরণ। আমাদের দেশ ফসলের জাত উদ্ভাবনে প্রথম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি ও চাল উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা ও আলু উৎপাদনে অষ্টম এবং খাদ্য উৎপাদনে দশম স্থান অধিকার করে কৃষি উন্নয়নের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সারা বিশ্বে। এসব অর্জনের প্রশ্নই উঠতো না, যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো। না হতো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দেশের কৃষকদের আত্মার আত্মীয়। তিনি সাংগঠনিক কাজে সারা বাংলার গ্রাম-গঞ্জ ঘুরেছেন। কৃষকের সাথে মিশেছেন। প্রাণ খুলে কথা বলেছেন। তাদের কষ্ট, দুঃখ ও বেদনার কথা অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করেছেন। তিনি বলতেন,‘ আমাদের সমাজের চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’
বাংলাদেশ ছিলো চির খাদ্য ঘাটতির দেশ। পাকিস্তানের দু’বছর পর স্বাধীন হয়ে চীন হোয়াংহু নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অজর্নে সক্ষম হলেও সুজলা সুফলা পূর্ববাংলার খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠি কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করে নি। তারা পূর্ব বাংলার পাট, চামড়া রপ্তানি করে ওই অর্থ দিয়ে ইসলামাবাদে নতুন রাজধানী তৈরি করে। বাঙালি জাতিকে চির দিনের জন্য গোলাম করে রাখার হীন উদ্দেশ্যে একটি নিপীড়ক সেনাবাহিনী গঠন কাজে ব্যয় করে পূর্ববাংলার কৃষিপণ্য পাট রপ্তানি আয়ের অর্থ। নীলকরদের মতো গঠন করে জুট রেগুলেশন বোর্ড। ষাটের দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি পূর্ববাংলার কৃষক ও কৃষি উন্নয়নের জন্য কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলার এই অবহেলিত কৃষি ও কৃষক ছিল প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। বন্যা, খরা , ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ছিল কৃষকের নিত্য সঙ্গী। দুর্ভিক্ষ ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লাখ লোক মারা যায় অনাহারে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রাক্কালে এক জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকের দুর্গতির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি পূর্ববাংলার কৃষকের প্রতি যে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে, সেই অপরাধের জন্য তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করে দেন। পাকিস্তান আমলে দাখিলকৃত সার্টিফিকেট মামলার অভিশাপ থেকে ১০ লাখ অসহায় কৃষককে মুক্তি দেন। তার সময়ে ৩ হাজার টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। মোট বাজেট পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ করা হয় ১০০ কোটি টাকা। প্রথম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনার শতকরা ৩১ ভাগ ছিল কৃষি খাতে। ওই সময়ে কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ করা হতো। তার সময়ে কৃষি উন্নয়নে বিএডিসি ও উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য পাট, তূলা ও আখসহ বেশ কয়েটি প্রধান কৃষি পণ্যের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
কৃষিতে জাতির জনকের গৃহিত পদক্ষেপের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে সারের মূল্য ৪ বার কমানো হয়। সেচে ভর্তুৃকি দেয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কৃষি পুনর্বাসনে প্রচুর নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়। নতুন নতুন ফসলে জাত উদ্ভাবন করা হয়। লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। এসব কর্মকা-ের ফলে দেশের চালের উৎপাদন ১১ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ মিলিয়ন টনে। আলুর উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখ টনে। সবজির উৎপাদন পৌনে দুই কোটি টনে। ফলের উৎপাদনও কম বাড়েনি। মাঠ ফসল ছাড়া মাছ, মাংস , দুধ ও ডিম উৎপাদনেও ঘটেছে একক অভাবনীয় বিপ্লব। এটা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি ও সহায়তার কারণে।
কিন্তু কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের ভাগ্যের উন্নতি হয় নি। কৃষক এখনো তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান না। পচনশীল কৃষি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক সময় কৃষকে উৎপাদিত কৃষি পণ্য রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ জানাতে হয়। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে লাভতো দূরের কথা আসল টাকাও উঠাতে পারেন না। ফলে তাকে ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। কৃষকের শতকরা ৮৫ ভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারাই কৃষি উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। তাদের হেক্টর প্রতি ফলন বেশি। অথচ তারাই সরকারি কৃষি ঋণ থেকে থাকেন সম্পূণ বঞ্চিত। তাদেরকে ফসল ফলানোর জন্য সুদখোর মহাজন, এনজিওগুলোর কাছে থেকে শতকরা ৩০ থেকে ৬১ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ গ্রহণ করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাসের কারণে মাঠের ফসল বিনষ্ট হলে এইসব প্রান্তিক কৃষকের কষ্টের সীমা থাকে না। করোনা অতিমারির সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় কৃষি ও কৃষক। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের ফলে প্রান্তিক কৃষকই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন। যদিও এ ব্যাপারে তাদের কোনো দায় নেই। বাংলাদেশের মতো কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় এত মধ্যস্বত্বভোগী আর কোনো দেশে নেই। নেই অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ফড়িয়া, দালাল, আড়তদার, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীÑএইসব মধ্যসত্বভোগীদের দৌড়াত্ম্যে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। কৃষক শুধু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষি পণ্যই উৎপাদন করেন। কিন্তু ওই কৃষি পণ্য সংরক্ষণের জন্য তার নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে কৃষক মহাজনের নিকট থেকে ধার দেনা করে এবং ব্যবসায়ীরে কাছ থেকে বাকিতে উ’ৎপাদন উপকরণ ক্রয় করে পণ্য উৎপাদন করেন, যা ফসল কাটার সাথে সাথেই তাকে পানির দামে মধ্যসত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছর ব্যবসায়ীরা ৮ টাকা কেজি দলে কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে তা বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। এবছর করোনার কারণে ভারত থেকে সময় ও পরিমাণ মতো পাট বীজ আমাদানি হতে পারে নি। কয়েক বারের উপর্যপুরি বন্যায় পাটের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মজুদদার ও ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে দুই/ আড়াই হাজার টাকা মণ দরে ক্রয় করা পাট এখন বিক্রি করছে ৪ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা মণ দরে। শোষণ কাকে বলে? গত দু’টি কোরবানি ঈদে পশু চামড়া নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকেরা সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে এতিম শিশুদের ভাগ্য নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলেছে, তা চামড়া শিল্পের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। শুধু চামড়া কেন, চাল, ডাল, ভোজ্যতেল নিয়েও কী কম সিন্ডিকেটিং হচ্ছে? কম কষ্ট দেয়া হচ্ছে স্বল্প আয়ের গরিব, দুঃখী মেহননি মানুষকে! সরকারি গুদামে চালের স্বল্প মজুদের সুযোগ নিয়ে মিলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত ৪৩ বছরেও চাল নিয়ে এ রকম চালবাজি করতে পারেননি এইসব ব্যবসয়ী সিন্ডিকেট। কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা ও মজুরি বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানে সরকার ৫০ থেকে ৭০ ভাগ ভর্তুকিতে তিন হাজার কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা ক্ষুদ্র ও প্রান্ত্রিক কৃষকের খ-িত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিতে তেমন কাজে লাগছে না। এটিও বাংলাদেশের কৃষির জন্য একটি বড় সমস্যা। এছাড়া কৃষিতে বিনিয়োগ কম এবং কৃষি গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দও অপ্রতুল।
ভারতে বর্তমান মোদি সরকারের সময়ে পাশ হওয়া কৃষি আইনের তিন দফা বাতিলের জন্য সারা ভারত জুড়ে চলছে এক ঐতিহাসিক কৃষি আন্দোলন। কৃষি পণ্যের নূন্যতম সহয়াক মূল্য বাতিলের মাধ্যমে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাছে কৃষের ভাগ্য সপে দেওয়ার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে সারা পৃথিবীতে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু আন্দোলনে অগ্রদূত গ্রেটা থুনবার্গ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সকল বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা এই আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছেন এই আন্দোলনে আত্মদানকারী কৃষকদের প্রতি। আমার মনে হয় কৃষকদের এই আন্দোলন একদিন চিকাগোর হে মাকের্টে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকের আত্মহুতির আগুনের শিখার মতো সারা বিশ্বে জ্বলে উঠবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভারতের কৃষি আন্দোলনের ঢেউ লেগেছে। এখানেও বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে কৃষি ভিত্তিক ভারী পাট ও চিনি শিল্প বন্ধের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদশের সমাজতান্ত্রিক দলের মতো আরো কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল। গত বছর দেশের সরকারি ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এবার ৬টি চিনি কলে উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে এবং আগামী বছর আরো ২টি চিনি কল বন্ধের কথা রয়েছে। চিনিকলগুলো বন্ধের কারণে ইতোমধ্যে চিনিকল এলাকায় আখ চাষ বন্ধ হয়ে গেছে বললে ভুল হবে না। তাই আগামী বছর সরকারকে আর কষ্ট করে চিনিকল বন্ধ করতে হবে না। আখের অভাবে ২/৩টি ছাড়া বাকী চিনিকলগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারি তাদের কর্ম হারবে। আখ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আখে থেকে চিনি উৎপাদন না হওয়ার কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ পড়বে। কৃষি শ্রমিকের কর্ম এলাকা সংকুচিত হবে। গ্রামীণ এলাকায় অর্থ প্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
১৯৭২ সনে বঙ্গবন্ধু সরকার শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষিদের স্বার্থেই চিনিকলগুলো জাতীয়করণ করেন। একই সাথে পাটকলগুলোও জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করে হঠাৎ করে কৃষি ভিত্তিক এই মিলকাখানাগুলো বন্ধ করা কোনো অবস্থাতেই উচিত হয় নি। কৃষি ভিত্তিক কলকারখানা বন্ধ করা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ও আদর্শের পরিপন্থি। তারপর তা আবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবং জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে। তাই কৃষি ও কৃষক তথা জাতীয় স্বার্থে পাটকল ও চিনিকল বন্ধের ঘোষণা অতি সত্ত্বর প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। সেই সাথে নিম্ন বর্ণিত সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন করাও দরকার।
সুপারিশ সমূহ হলো-১.ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের স্বল্প সুদে সময় মতো কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে। ২.কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত কল্পে কৃষক প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণে কৃষি পণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে। ৩.দানাশস্য বিশেষ করে উৎপাদিত ধান, গম ও ভূট্টার কমপক্ষে শতকরা ১০-১৫ ভাগ সরকারিভাবে ক্রয় করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে ইউনিয়ন পর্যায়ে খাদ্য গুদাম নির্মাণ করতে হবে। ৪. উৎপাদন খরচের সাথে শতকরা ২০ ভাগ লাভ যোগ করে কৃষি পণ্যের নূন্যতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। ৫.বিষমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য সকল প্রকার জৈব বালাইনাশক এবং পোকা-মাকড় ও ইঁদুর দমন ফাঁদের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নাম মাত্র মূল্যে এইসব পরিবেশবান্ধব কৃষি উপকরণ কৃষকের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬.প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি হতে কৃষকদের বাঁচানোর জন্য অবিলম্বে কৃষি বীমা চালু করতে হবে এবং প্রিমিয়ামের টাকা সরকারকে বহন করতে হবে। ৭.ষাটোর্ধ্ব কৃষকদের পেনশন চালু এবং ক্ষেতমজুরদের সারা বছর কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ৮. সারা দেশের জেলা, উপজেলা ও পৌরশহরগুলোতে ভোক্তার কাছে সরাসরি কৃষি পণ্য বিক্রয়ের জন্য কৃষক বাজার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৯. কৃষিপণ্য বিপণন প্রক্রিয়ায় মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১০. এলাকা ভিত্তিক কৃষি পণ্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। ১১. কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভ্যান ও রেলওয়াগন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ১২. বন্ধকৃত সকল কৃষি ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করতে হবে। ১৩. কৃষি জমির আশেপাশে ইটভাটা নির্মাণ এবং ইট তৈরি কাজে টপ সয়েল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ১৪. শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য ফেলে কৃষি জমির উর্বরতা বিনষ্টের মতো আত্মঘাতি কাজ বন্ধ করতে হবে। ১৫. ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের নাম মাত্র ভাড়ায় ধান রোপণ এবং কাটা-মাড়াই-ঝাড়াই যন্ত্রের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ১৬. কৃষি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বাজেট বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে কৃষি গবেষণা খাতেও বাজেট বরাদ্দ। সেই সাথে টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি প্রতিটি নগরে পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি:।