।। ফজলে হোসেন বাদশা ।।
সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের সামনে এক অভিনব ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। এর পেছনের কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের একটি যৌথ নিরাপত্তা প্রচেষ্টা, যা কোয়াড বলে পরিচিত। চ্যালেঞ্জটা অভিনব দুটো কারণে।
প্রথমত, কোয়ড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা কিউএসডি অথবা কোয়াড বলে পরিচিত এই যৌথ উদ্যোগ আসলে আনুষ্ঠানিক কোনো জোট হয়ে ওঠেনি এখনও। অংশগ্রহণকারীরাও একে অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংলাপ বিষয়ক মঞ্চ হিসেবেই এখনও উপস্থাপন করে চলেছেন। ২০০৭ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এখানে নতুন কোনো সদস্য নেয়া হয়নি এবং হবে কি না সে ব্যাপারে কোনো প্রকাশ্য তৎপরতাও চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, আপাতত কোয়াডের আনুষ্ঠানিকতার ধারেপাশে কোথাও বাংলাদেশ নেই। চারদেশের এই নিরাপত্তা সংলাপের মঞ্চ থেকে বাংলাদেশকে যোগ দেয়ার কোনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এখানে যুক্ত হতে কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি।
তার মানে, বাস্তবতা হলো, এখনও জোট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গড়েই ওঠেনি এমন একটি যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ কোনোভাবে জড়িত না থাকলেও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আর সে কারণেই ব্যাপারটা অভিনব। বিশেষ করে ‘কোয়াডে যোগ দিলে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে’- সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূতের এমন প্রকাশ্য মন্তব্যে এই আলোচনা আরও গুরুতপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনা দূতের এই মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান জানিয়েছে, যেখানে এ ধরনের মন্তব্যকে আগ বাড়িয়ে দেয়া হিসেবে মনে করা হচ্ছে। আবার পরে চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে মন্তব্যটিকে ভাষাগত সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যদিও চীন কোয়াডের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর মনোভাব সেদিনও ব্যক্ত করেছে। কূটনৈতিক মহলে অনেকে চীনের এই প্রকাশ্যে সরব হওয়ার বিষয়টিকেও অভূতপূর্ব বলে মনে করছেন।
প্রশ্ন হলো, চীন কেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের সামনে সরাসরি হাজির করলো? ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ দিকে গেলো বছরের অক্টোবরে হঠাৎ করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট স্টিফেন বেইগান ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে আসেন। দিল্লি হয়ে ঢাকায় এসে তিনি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ বৈঠক সারেন। এরপর সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিকে অন্যতম মূল অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে। আর ভূরাজনৈতিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে কোয়াডকে সম্পৃক্ত হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
এ বছরের শুরুর দিকেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের ঢাকা সফর নিয়েও কূটনৈতিক মহলে কৌতূহল ছিলো। সেই সময় অনেকের ধারণা ছিলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াড নিয়ে বাংলাদেশকে উৎসাহী করতেই তাদের এই সফর। যদিও অফিসিয়ালি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এই সফরকে দেখানো হয়। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেই সফরেই একটি ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি ব্রিফিংয়ে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক কানেকটিভিটি নিয়ে কথা বলেন। এর মধ্যে তৃতীয় দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বলেও মত দেন। এরপরই গত মাসে দ্রুততার সাথে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিন উইফেং ঝটিকা সফরে আসেন। রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সফরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোয়াড নিয়ে তাদের অস্বস্তির ইঙ্গিত দিয়ে যান বলেই কূটনীতিক মহলে প্রচার আছে।
কাজেই, দেখা যাচ্ছে, চীনা দূত কোয়াড নিয়ে হঠাৎ করেই কথা বলেছেন- এমন নয়। বিষয়টি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ চলছে দুই তরফেই এবং তার ধারাবাহিকতায় লি জিমিং কথা বলেছেন। স্পষ্ট বোঝা যা্চ্ছে, কোয়াড নিয়ে ভারত মহাসাগরের এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ হতে চলেছে। এর একপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত। অন্যপক্ষে কোয়াডের বিরোধিতায় কোমর বেঁধেছে চীন। আপাতত চীন একা কথা বলছে। তবে এ অঞ্চলে মার্কিন অভিপ্রায় ঠেকাতে যে তাদের পাশেও কৌশলগত মিত্ররা থাকবে, তা বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের কাছে যে প্রশ্নটা এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, বাংলাদেশ কী করবে? কীভাবে এই অভিনব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে?
এ প্রসঙ্গে আলাপ করতে গেলেও সেই পুরনো কথা বলতে হয়, আমাদের দেশের নানা সংকটের রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের সংবিধান পথ দেখিয়েছে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ এই ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনে আমাদের সংবিধান নির্দেশিত পথে ভূমিকা রাখতে পারলেই আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একাধিকবার বলেছেন, জোটনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বে কোনো ধরনের সামরিক মেরুকরণে পক্ষপাত নেবে না এমনটাই আমাদের নীতি। দুই দিক দিয়ে এই বিদেশনীতি পর্যালোচনার দাবি রাখে, প্রথমত দেশের বাইরে সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সাথে সংগতিপূর্ণ কিনা; দ্বিতীয়ত নিজেদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন ব্যতিরেকে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর সামরিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্ম হলে ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কী হবে। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নীতি আমাদের নেই। সংবিধানে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট অবস্থান আছে। ফলে যেকোনো বিবাদমান পরিস্থিতিতে একটি পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়া আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য এবং আঞ্চলিক ও বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ কারণেই নানাবিধ আলোচনা থাকরেও সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কোনো সামরিক চুক্তিতে যুক্ত হয়নি।
আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্কে অভ্যস্ত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে কোয়াড, সেখানে আমাদের ঐতিহাসিক মিত্র ভারত রয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, তার সূত্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে গাঁথা। আবার জাপান দীর্ঘ সময় ধরেই আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। তাদের সহায়তায় বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে ও হচ্ছে।
অন্যদিকে চীনও গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্বমণ্ডলে চীনের সঙ্গে যে রাশিয়ার সুসম্পর্ক, তাদের সঙ্গেও আমাদের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কটিও আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গেই যুক্ত। যদিও কোয়াড নিয়ে চীনের যে প্রকাশ্য বিরোধিতা, সেখানে এখনও রাশিয়া সরব হয় নি। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই বিরোধ খানিকটা গড়ালে রাশিয়ার কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াডের পক্ষে থাকার সুযোগ নেই।
এই সবগুলো দেশের সঙ্গেই আমাদের পৃথক যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তা অত্যন্ত সহায়তাপূর্ণ ও দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু সেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সঙ্গে তাদের কোনো বহুপাক্ষিক সম্পর্কে যুক্ত হবার দায় আমাদের নেই। যতক্ষণ না বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত না হয়। বিষয়টা খুব স্পষ্ট, আমরা আমাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মূলতঃ অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। সে কারণে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত জোট বা ফোরামে বহুপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশ ইতিবাচক। কিন্তু সামরিক কোনো জোটের প্রতি আমাদের আগ্রহের সুযোগ সংবিধান অনুযায়ীই নেই। কাজেই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সব পক্ষকেই এই বাস্তবতা মাথায় রাখা জরুরি।
উপরন্তু, বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই অবস্থান নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সব থেকে আলোচিত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটেও আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। ফিলিস্তিনী জনগণকে যেভাবে হামলার মুখে পড়তে হয়েছে, তার নিন্দা বাংলাদেশ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের এই ভূমিকার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তা রয়েছে। আজ বার্নি স্যান্ডার্সের মতো মার্কিন রাজনীতিক ও নোম চমস্কির মতো মার্কিন বুদ্ধিজীবীরাই একথা জোর দিয়ে বলছেন। এর আগে আমরা মধ্যপ্রাচ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিকা দেখেছি। মুখে শান্তির কথা বললেও তাদের কোনো তৎপরতাই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, বরং আরও অশান্তি চড়িয়েছে। কাজেই তাদের নেতৃত্বাধীন কোনো সামরিক জোট শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠায় কতটা ভূমিকা রাখতে পারে- তা নিয়ে সন্দেহ থাকাটাই স্বাভাবিক। আর বাংলাদেশের বিদেশনীতিতে এই শান্তি ও সহাবস্থানই অগ্রাধিকার পায়।
দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে নানা কারণে সম্পর্কের সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই সংকটে বাংলাদেশের অবস্থান কোনোভাবে যেনো কারো জন্য অস্বস্তিকর না হয়, সে ব্যাপারে তৎপরতা ছিলো এবং আছে। বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যারাই এদেশে রাজনীতি করেছে, তারা এই বিষয়টি যথেষ্ট সক্ষমতার সঙ্গে নিশ্চিত করেছে। চীন বা ভারত কারো জন্যই তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি উস্কে দেয়া বা সহায়তা করার মতো কোনো অবস্থানকে আমরা কোনোভাবেই সঠিক মনে করি না। বরং আমরা আশা করি, এ অঞ্চলের এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যেও পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। কিন্তু অবশ্যই সেটা তাদের যার যার রাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানের ব্যাপার। বাংলাদেশ ভিন্ন মাত্রায় দুটি রাষ্ট্রের সঙ্গেই যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যুক্ত, তার পরিচর্যা যথাযথভাবে করতে চায়। পাশাপাশি আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে আমাদের বন্ধুরাও আমাদের এই বাস্তবতা বুঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই কাজ করবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং সংসদ সদস্য রাজশাহী-২ আসন।