করোনায় কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ
* আয়ে সন্তুষ্ট নন ৮৬ শতাংশ * কর্মহীন বেকারের মিছিল বাড়ছে * চাপা কান্নার আওয়াজ মধ্যবিত্ত পরিবারে
এমএইচ নাহিদ: বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। তা বাড়ানো হয়েছে ১৬ মে পর্যন্ত। কঠোরতার ঘোষণা দেয়া হলেও লকডাউন চলছে বেশ ঢিলেঢালাভাবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে লকডাউনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিপদে পড়েছেন গরিব-নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। কাজ হারিয়ে অথবা কাজে ফিরলেও আয় কমে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। চাপা কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন মধ্যবিত্তরা। আর শ্রমজীবীরা বলছেন,“করোনায় মারা না গেলেও আমরা ক্ষুধা’তেই মারা যাব। তাই আমাদের কাছে করোনার চেয়েও মহাচিন্তা ক্ষুধা।” বাস্তব পরিস্থিতিও তাই। গত ২ বছরে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ গরিবের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন-এ তথ্য উঠে এসেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এর জপির প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৮ সালের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী দারিদ্র্যের হার ছিল ২১ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত ২ বছরে সানেম-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী তা বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১ বছরে কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ মানুষ। আর ওয়াশিংটন ভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালপ বলছে, বিশে^র ৫৭ দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪৮ শতাংশ পরিবারের অনন্তত ১ জন করে বেকার হয়েছেন। বাড়ছে বেকারের মিছিল। বাড়ছে কর্মহীন মানুষের হাহাকার।
জানাগেছে, করোনায় উচ্চবিত্তের সমস্যা না হলেও গরিব-মধ্যবিত্তরা মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছেন। কর্ম হারিয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। সিপিডি তাদের জরিপ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, করোনায় গত ১ বছরে সারাদেশে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অনেকেই কাজ শুরু করলেও অধিকাংশের আয় কমেছে। ফলে শতকরা ৮৬ ভাগ মানুষ তাদের আয় নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ব্যয় কমিয়েছেন ৭৮ শতাংশ মানুষ। ৫২ শতাংশ খাদ্যাভাস পরিবর্তন করেছে। আর ঋণ বেড়েছে ৫০ শতাংশের। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। সিপিডি’র এই প্রতিবেদন করোনার প্রথম ধাক্কায় করা। দ্বিতীয় ঢেউয়ে যারা কর্ম হারিয়েছেন তারা এই প্রতিবেদনের বাইরে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যারা কাজে ফিরেছেন, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ স্ব-নিয়োজিত খাতে ফিরেছেন। অথবা দৈনিক শ্রমিকের কাজ করছেন।
করোনায় সবকিছু চললেও বন্ধ আছে পরিবহন খাত। সীমিত আকারে অনুমতি দেয়া হলেও তাতে পুরোপুরি লাভ হচ্ছে না। এ খাতে কর্মরত ৮০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন ডেইলি ভিত্তিতে। ট্রিপ দিলে টাকা পায়, না দিলে টাকাও বন্ধ। ফলে তারা বড়ই কষ্টে আছেন। বিপদে আছেন হোটেল-রেস্তরাঁর শ্রমিকরাও। কষ্টে দিন কাটছে ৪০ লাখ পোল্ট্রি ফার্ম শ্রমিকদের। আবার বাসাবাড়িতে কাজ করা লাখ লাখ গৃহকর্মীও কর্মহীন দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছেন। করোনার কারণে তারা বাসাবাড়ির কাজে যেতে পারছেন না। নানা সেক্টরে টিকা দেয়ায় অগ্রাধিকার দেয়া হলেও গৃহকর্মীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এছাড়া নিদারুণ কষ্ট করছেন দেশের অসংগঠিত খাতের শ্রমিকরা। তাদের কর্মহীন জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে ক্ষুধাই বড় চিন্তা। এসব গরিব মানুষ মৃত্যুকে ভয় পান না। কারণ তারা প্রতি নিয়ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করেন। করোনায় সবকিছু বন্ধ থাকলে তারা এবং তাদের পরিবারের পেট তো খাবার চায়। সেই খাবারের সন্ধানে তাদের কাজে বের হতে হয়। ফলে করোনায় মৃত্যুকে পরোয়া না করে তারা ছুটতে চান কাজে। এসব গরিব-মধ্যবিত্তকে বাঁচাতে হলে এবং করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউনের সফল বাস্তবায়ন চাইলে সবার আগে গরিবের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। থামাতে হবে মধ্যবিত্তের চাপা কান্না। তাদেরকে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা জরুরি। সরকার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু তা সবার ঘরে পোঁছাচ্ছে না। কারণ করোনার সহায়তায় চলছে স্থানীয় আমলা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের আগ্রাসন। এ আগ্রাসন বন্ধে আন্তরিক হতে হবে। তা না হলে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যত পরিকল্পনাই করা হোক তা সফলতার মুখ দেখবে না। কারণ প্রয়োজন যেমন আইন মানে না, তেমনি গরিবের ক্ষুধাও করোনাকে ভয় পায় না। তারা পেটে খাবার চান। সেই পদক্ষেপ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানাতে হবে-বলছেন বিশ্লেষকরা।