বিশেষ প্রতিনিধি : দুর্যোগ হলেই ত্রাণের দাবি, ক্ষয়ক্ষতি পূরণের দাবি। কিন্তু ভিন্ন চিত্র খুলনার উপকূলীয় এলাকায়। মানুষ আর ত্রাণ চায়না। সহযোগীতা চায় না। তাদের দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধের। দুর্নীতি-লুটপাটমুক্ত অর্থ ব্যয়ের। সরকারি অর্থের পুরোপুরি ব্যবহারে।
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ও ভরা পূর্ণিমার প্রভাবের ভয়ে গত কয়েকদিন ধরেই এই উপকূলের দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছার বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। মঙ্গলবার (২৫ মে) ও বুধবার (২৬ মে) সারা দিন-রাত বাড়িতে নয়, বেড়ি বাঁধে কাটিয়েছেন। সরেজমিন কয়রা, পাইকগাছার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে ও উপকূলের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে এ চিত্র মিলেছে।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার গনেশ মন্ডল (৪৫)। সকাল থেকে শাকবাড়িয়া বাঁধে তিনিও কাজ করছেন। গনেশ মন্ডল স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেও সাধারণ সম্পাদক। বালুর বস্তা বহন করতে করতে নিজের ঘাড়ের অবস্থা দেখাচ্ছিলেন। সেখানে লাল ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা। মানুষকে কত আর বাঁধের প্রতিশ্রুতি দেয়া যায়। বাঁধ হলেও টেকে না। এখানে জন্ম অভিশাপ। সেই অভিশাপ ভোগ করছি।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন ‘ওয়াবদা’ শুরু করেন, তখন তিনি উপকূলে ৫ ফুট উচ্চতার টেকসই বাঁধের কথা বলছিলেন। এখন জলবায়ূ পাল্টাচ্ছে, পানি বাড়ছে। কিন্তু বাঁধ হচ্ছে নড়বড়ে কম উচ্চতার। আর প্রতিবছর যুদ্ধ করছি- এটা লজ্জা। কমপক্ষে সাড়ে ৫ফুট উঁচু-৬ ফুট প্রশস্ত টেকসই বাঁধ না হলে কিছু হবে না।’
স্থানীয় বাসিন্দা দেবরঞ্জন সরকার, সঞ্চয় সরকার বলেন, ‘অল্প মাটি দিয়ে ঠিকাদাররা কোনভাবে বাঁধ দিচ্ছে। ঢেই আসলে ভেসে যায়। ব্লক দিয়ে টেকসই করতে হবে। এসব হয়না বলেই বাঁধ ভাঙ্গে।’
শাকবাড়িয়ার মতিয়ার রহমান (৫৫) বলেন, ১৩-১৪/পোল্ডারে বাঁধের কাজ কয়দিন আগে শেষ হয়েছে। নামেমাত্র জিও ব্যাগ দিয়েছে। আরেক সারি জিও ব্যাগ দিলে এ অবস্থা হতো না। কিন্তু আমরা ভয়ে কিছুই বলতে পারিনা। আবার পানিতে ডুবে মরতে হয়।’
কাটকাটা এলাকার আজিজুল ইসলাম কাটকাটা এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধের কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘এমন পানি আগে হয়নি। বাঁধ উঁচু করতে হবে। না হলে আমরা এখানকার কেউ বাঁচবো না।’
বুধবার মহারাজপুরে ভেঙ্গে যাওয়া পবনা বেড়িবাঁধ এলাকার রহিমা বেগম (৫৫) বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘সকালে একটু খাবার খেয়েছিলাম। দুপুরে কিছু খেতে পারিনি। কিভাবে খাবো; সবতো ভেসে যাচ্ছে। বাড়ি-পুকুর লবণ পানিতে। রান্নার করার জায়গা নেই। এভাবে প্রতিবছর কীভাবে আমরা বাঁচবো?’
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ এ তিন উপজেলার ২০টি স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এতে তিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রাম। তবে পুরো তির পরিমাণ নিরূপণ করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কয়রা নদীর ১৩-১৪/২ নম্বর বাঁধ জোয়ারের পানির চাপে ভেঙে গেলে প্লাবিত হয় মঠবাড়ি এলাকা। বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রায় ৪ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ভেঙে গেছে। দণি বেদকাশী ইউনিয়নের শাকবাড়িয়া নদীর আংটিহারা, বীণাপানি এলাকা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের একই নদীর গাতিরঘেরি, পদ্মপুকুর এলাকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়রা নদীর তেঁতুলতলা, চৌকনি, শিংয়ের চর এলাকা, মহারাজপুর ইউনিয়নের কয়রা নদীর পবনা ও মঠবাড়ি এলাকা এবং কপোতা নদের দশালিয়া এলাকার বাঁধ ভেঙে গেছে।
পাইকগাছা উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৭ টি স্থানের বাঁধ ভেঙে গেছে। তিগ্রস্ত হয় ২৫ কিলোমিটার ও ভেসে গেছে ১০০ মিটার বাঁধ। এতে ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা ভেঙ্গে যায়, কাঁচা রাস্তা তিগ্রস্থ হয় ২০ কিলোমিটার। ১ হেক্টর ফসলি জমি ও ৬শ’৬০ হেক্টর চিংড়ি ঘের। পাইকগাছায় তির পরিমাণ ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
দাকোপ উপজেলায় তীলডাঙ্গা ইউনিয়নের সোনার বাংলা কলেজের পাশের সুইসগেট এলাকার বাঁধ ভেঙে গেছে। এছাড়া ১০ থেকে ১২টি স্থান বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
অপরদিকে পাইকগাছায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে ওয়াপদার দূর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ব্যাপক য়তি হয়েছে। বুধবার বেলা ১১/১২টার দিকে ভরা পূর্ণিমার জোয়ারে অসংখ্য স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এ ছাড়া বাঁধ উপচে বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। ওয়াপদার বাইরের বেশিরভাগ চিংড়ি ঘের এবং ভিতরের অসংখ্য ঘের তলিয়ে কোটি কোটি টাকার মৎস্য ভেসে যায়। বিনষ্ট হয় কৃষি ফসল সহ ঘর-বাড়ী ও রাস্তা ঘাট। তিগ্রস্থ হয়েছে ২২ হাজার পরিবার।
অনির্বাণ লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক প্রভাত দেবনাথ জানান, হরিঢালী ইউনিয়নের মাহমুদকাটীর মালোপাড়া এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে এলাকার অনেকাংশ তলিয়ে যায়। আনসার ও ভিডিপি প্রশিক আলতাপ হোসেন মুকুল জানান, কপিলমুনি ইউনিয়নের আগড়ঘাটা বাজার সংলগ্ন পদ্মপুকুর এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়।
ইউপি চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জন মন্ডল জানান, লতা ইউনিয়নের পশ্চিম লতা, ধলাই গেট সহ বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে মৎস্য ঘের সহ রাস্তা ঘাটের ব্যাপক তি হয়েছে। শিক সুকৃতি মোহন সরকার জানান, দেলুটি ইউনিয়নের জকারহুলা, মধুখালী, চকরি-বকরি মুনকিয়া-দিঘলিয়া ও দেলুটির পূর্বপাশ সহ অনেক এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে ব্যাপক য়তি সোলাদানা ইউনিয়নের সোলাদানা বাজার, ভাঙ্গাড়িয়ার পরিমল মাস্টারের বাড়ীর সামনে ১ কিলোমিটার, পাটকেলপোতা স্লুইচ গেটের পাশে, মিস্ত্রীপাড়া, হরিখালী, পারিশামারী, নুনিয়াপাড়া, সোলাদানা, পতন, বেতবুনিয়া ও হরিখালী আবাসন সহ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক তি হয়েছে। পানিবন্দী লস্কর ইউনিয়নের আলমতলা হাটের ওপারে, কড়–লিয়া আনিচের ঘের হতে শাহআলম মেম্বরের বাড়ী পর্যন্ত, বাইনতলা, লস্কর উত্তর ওয়াপদা, পশ্চিম বিলের মান্নানের গেট, কড়–লিয়া বিশুর বাড়ি হতে শিববাটী ব্রীজ পর্যন্ত এবং স্মরণখালীর ত্রিনাথ বাছাড়ের বাড়ীর সামনের গেট ও ভড়েঙ্গা গেট ভেঙ্গে এবং বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ গোলদার জানান, রাড়–লী ইউনিয়নের তোড়াডাঙ্গা ও ভড়বুড়িয়া এবং মালোপাড়াসহ কয়েকটি স্থানের বাঁধ ভেঙ্গে এবং উপচে এলাকায় য়তি হয়।