করোনা ,আম্পান ও বন্যায় প্রায় ৪ কোটি মানুষ দ্রারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছেন। কর্ম হারিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন প্রায় ৮০ হাজার লোক। কেউ কেউ কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রাজধানীসহ বিভিন্ন নগরগুলিতে যেসকল মহিলারা স্বামী-স্ত্রী মিলে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন, তারা অনেক আগেই করোনার কারণে কাজ হারিয়ে বিপদে পড়েছেন। শ্রমজীজী মানুষ তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেন মোটা চাল ক্রয়ে। রিক্সা , ভ্যান চালক, গার্মেন্ট শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি ,রংমিস্ত্রি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মিলকারখানার শ্রমিক, কৃষিশ্রমিকসহ একটি বড় অংশের মানুষের প্রধান খাবার মোটা চাল। চালের দাম বেড়ে গেলে তারাই দুর্দশার শিকার হন বেশি। খেটে খাওয়া মানুষের বেড়ে যায় দুর্ভোগ।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, দেশে চালের অভাব নেই। খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, চালের কোনো সঙ্কট হবে না। তারপরও গত কিছু দিন ধরে হুহু করে বাড়ছে চালের দাম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫.৫৫ মিলিয়ন ( ৫৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন) চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্য খাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ৩.৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকে হিসাব করে জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০.৩১ মিলিয়ন (২ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার) টন চাল ছিল। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ১৬.৫ কোটি মানুষের চাহিদা মেটানোর পরও ৩৬ থেকে ৭৮ দিনের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া নভেম্বর মাসের মধ্যে দেশের খাদ্য ঝুড়িতে নতুনভাবে আউস ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হবে। চাল উদ্বৃত্তের এ ধরণের সংবাদটি দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গুরুত্বসহকারে প্রকাশের পরও গত কিছু দিন ধরেই দেশে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের কারণে।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’এর হিসেবে গত এক বছরের ব্যবধানে স্বল্প আয়ের মানুষের মোটা চাল স্বর্ণা/গুটিস্বর্ণার দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। আর সরু চাল নাজিরশাইল/ মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে প্রতিকেজি মোটা চালের খুচরা মূল্য ৪২ থেকে ৪৮ টাকা, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা। অন্যদিকে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ( এফএও ) পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে বছরে জনপ্রতি চাল পরিভোগের পরিমাণ ১৬০ কেজি, যা বৈশ্বিক জনপ্রতি বার্ষিক গড় ৫০ কেজির চেয়ে তিন গুণেরও বেশি। কারো কারো মতে, বাংলাদেশে জনপ্রতি বার্ষিক চাল ব্যবহারে পরিমাণ ১৮২ কেজি। সে হিসেবে দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্টিসহ মোট ১৬ কোটি ৬১ লাখ মানুষের জন্য বছরে চালের প্রয়োজন ৩ কোটি ২ লাখ মেট্রিক টন। গত আমন মৌসুমে দেশে ১ কোটি ৪০ লাখ, বোরো মৌসুমে ২ কোটি এবং চলতি আউস মৌসুমে যদি ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাউলও উৎপাদিত হয়, তাহলে দেশে তিন মৌসুমে উৎপাদিত মোট চালের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদিত চাল থেকে পরিভোগ বাবদ ৩ কোটি ২ লাখ টন বাদ দিলে উদ্বৃত্ত চালের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৮ লাখ মেট্রিক টন। তা হলে বাজারে চালের দাম হুহু করে বাড়বে কেন?বিদেশ থেকে চাল আমদানির প্রশ্ন উঠছে কেন? তাহলে কি উদ্বৃত্ত চালের চালবাজিতে দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ?
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কথা, এবার দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে ধান-চালের ঘাটতি নেই। তাই হঠাৎ করে এভাবে চালের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অসাধুচক্র চালের বাজার অস্থির করার পাঁয়তারা করছে। একারণে বাজার অভিযান জোরদার করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেয়া হয়েছে। বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি এবং বাজার অস্থির করার অপকৌশল নিয়ে দাম বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেড় লাখ টন চাল দেয়া শুরু হয়েছে। খোলা বাজারে বিক্রি বাড়ানো হয়েছে। সরকারের হাতে এখনো ১৪ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে। এরপরও ঘাটতি হলে আমদানির কথা ভাবা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ।
এবছর বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল কৃষক ও মিলমালিকদের কাছ থেকে সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করার। সংগ্রহের সময় ছিল ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত। সংগ্রহ সন্তোষজনক না হওয়ায় ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে দিয়েও সরকারের সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় নি। চালের আকারে বোরো মৌসুমে ১৬ লাখ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে ৯ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশি। বোরো মৌসুমে এবার বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষক সরকারি গুদামে ধান সংগ্রহ করেনি। খাদ্য অধিদপ্তরের হুমকি-ধমকি সত্তে¡ও মিলমালিকেরা চুক্তি অনুযায়ী সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করেন নি। মিলমালিকদের কথা, ৩৬ টাকা কেজি দরে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করলে তাদের কেজি প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা লোকসান গুণতে হবে।
২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যায় বোরো ধান নষ্ট হলেকৃষি মন্ত্রণালয় বলেছিল ক্ষতির পরিমাণ ৬ লাখ মেট্রিক টন আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলেছিল ক্ষতির পরিমাণ ১২ লাখ মেট্রিক টন। এ কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাল আমদানির ওপর থেকে শুল্ক তুলে দেয়। সেই সুযোগে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ৭০ লাখ টন চাল আমদানি করে কৃষকের বারাটা বাজান। এ কারণে ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত কৃষককে উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হতে হয়। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে প্রতিবছর দেশে ২০ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন করে চাল আমদানি করা হয়। তখনো কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘ দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করতে হবে।’ আজ থেকে ৪৭ বছর আগের জাতির জনকের উক্তিটি এখনও বড় প্রাসঙ্গিক। বড় বেশি বাস্তব। চাইলেই বিশ্ব বাজার থেকে সিদ্ধ চাল কেনা যায় না। বাংলাদেশ চাল আমদানির ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে বিশ্ব বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্ব বাজারে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম ৪৬ টাকা,যা দেশের খুচরা বাজার মূল্যের প্রায় সমান। চাল আমদানির ইতিহাস বাংলাদেশর জন্য মোটেও খুব সুখকর নয়। ফকরুদ্দীন আহমদের তত্ত¡াধায়ক সরকারের সময় রাসায়নিক সারের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে চালের উৎপাদন কমে মূল্য বেড়ে যায়। ওই সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত চুক্তি করেও বাংলাদেশে চাল সরবরাহ করেনি। তখন সরকারকে অনেক বেশি দামে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে দেশের খাদ্য সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থ বছরে বিশ্বে চাল উৎপাদিত হবে ৫০১.৯৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আর এর আগের বছর বিশ্বে চাল উৎপাদিত হয়েছিল ৪৯৩.৭৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। সে হিসেবে ২০২০-২১ অর্থ বছরে বিশ্বে চালের উৎপাদন বাড়বে ৮.১৭ মিলিয়ন টন, অর্থাৎ ১.৬৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পৃথিবীর শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীনে ১৪৯, ভারতে ১১৮.বাংলাদেশে ৩৬, ইন্দোনেমিয়ায় ৩৪.৯, ভিয়েতনামে ২৭.৫, থাইল্যান্ডে ২০.৪ , মিয়ানমারে ১৩.১, ফিলিপাইনে ১১, জাপানে ৭.৬৫ এবং পাকিস্তানে ৭.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও চাল উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম ছিল চীন, দ্বিতীয় ছিল ভারত এবং তৃতীয় ছিল ইন্দোনেশিয়া। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের শীর্ষ তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশের গৌরব অর্জন করে যা,দেশের কৃষক ও কৃষির জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি ও গর্বের বিষয়।
বিশ্বে চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ তৃতীয় দেশটি কেন অন্য দেশ থেকে চাল আমাদানি করবে? বিষয়টি আমার মতো অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে। এ ব্যাপারে আরো অনুসন্ধান, গবেষণা, পর্যবেক্ষণ, বিচার বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞগণের মতামত নেয়া প্রয়োজন। কারণ চাল নিয়ে দেশেে রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী ও মিল মালিকেরা কম রাজনীতি করেন না। দেখা গেছে, এ বছর বোরো ধানের যৌক্তিক মূল্য পাওয়ায় আমন ধান চাষে কৃষকের আগ্রহ বহু বেড়ে গেছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার, চারা রোপণ, পরিচর্যা, সার প্রয়োগ এবং পোকামাকড় ও রোগরালাই দমনে তাঁরা আগের বছরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং ফলন বাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
ভয়ের বিষয়, কোনো কারণে যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল আমদানি করা হয়, তা হলে পরবর্তীতে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে চালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিরুৎসাহিত হবেন। উৎপাদন বৃদ্ধির ধারবাহিকতা ব্যাহত হবে। অন্যদিকে পণ্যটির সঙ্কট হলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যাবে এবং নি¤œ আয়ের শ্রমজীবী মানুষের বিপদ বাড়বে। তাই চাল আমদানি ও শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
লেখকঃ কৃষি গবেষক ও সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ত্রিশাল উপজেলা কমিটি, ময়মনসিংহ।