পরিবারের জানাশোনার মধ্যেই বিয়ে করেছিলেন রাজধানীর সবুজবাগের বাসিন্দা আজফারা (ছদ্মনাম)। তিনি নিজে বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। স্বামী ব্যবসায়ী। ঘটা করে বিয়ে হয়। দুই বছর বাদে মেয়ের জন্মে আজফারার বাবার বাড়িতে আনন্দের বন্যা বইল। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে মিশ্র অনুভূতি। খুব দ্রুতই দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করলেন তিনি, অনেকটা বাধ্য হয়েই। এবারও মেয়ে। তৃতীয়বার গর্ভধারণের পর শ্বশুরবাড়ির লোক ও স্বামী চাইলেন সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে তা দেখে নিতে। আজফারা বিপদ টের পেলেন। যদি মেয়ে হয়? প্রতিজ্ঞা করলেন, সন্তান যা–ই হোক, তা তিনি নষ্ট করতে দেবেন না। পরীক্ষায় ছেলেসন্তানের অস্তিত্বে স্বস্তি পেলেন এই মা।
আজফারা বলছিলেন, ‘আমি মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। সন্তান নষ্ট হতে দেব না, এই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারতাম কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। হয়তো পরিবারে অশান্তি দেখা দিত। আরও খারাপ কিছু হতে পারত। কিন্তু ছেলেসন্তান হওয়ায় সবাই খুশি হলো।’
ছেলেসন্তানের প্রতি এই অতি আগ্রহ এ সমাজে নতুন কোনো বিষয় নয়। অনেক দেশেই আছে। মেয়েশিশুর প্রতি এ এক নিষ্ঠুরতা। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ৩০ জুন প্রকাশিত বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদনে (২০২০) বলছে, ছেলেশিশু পছন্দের মতো এমন অন্তত ১৯ ধরনের ক্ষতিকর চর্চার শিকার হতে হয় সারা বিশ্বের মেয়েশিশু ও নারীদের। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রতিবেদনে এ ধরনের ক্ষতিকর চর্চার মধ্যে বাংলাদেশে দুটি চর্চা বেশি হয়। সেগুলো হলো, বাল্যবিবাহ এবং ছেলেসন্তানের জন্য মেয়েদের প্রতি বৈষম্য।
বিশ্বের যে ১০টি দেশে পাঁচ বছর বয়সী মেয়েশিশুর মৃত্যুহার অপেক্ষাকৃত বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে। ইউএনএফপিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে এ হার ২ দশমিক ১ শতাংশ। পাঁচ বছর বয়সী মেয়েশিশুর মৃত্যুহারের নিরিখে এ হার ২ দশমিক ৬। ছেলেশিশু পছন্দের বিষয়টিকে একধরনের লিঙ্গবৈষম্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা এক ছেলে এবং এক মেয়ে এমন একটি সমন্বয় পছন্দ করেন। কিন্তু এ পছন্দের মধ্যে অবশ্যই একটি ছেলে থাকাটা আবশ্যিক।
ছেলেসন্তান পছন্দ বা জেন্ডারভিত্তিক লিঙ্গ নির্বাচন একটি ক্ষতিকর চর্চা। এর মাধ্যমেই ছেলেশিশু নির্বাচন করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে এসব ক্ষতিকর চর্চা কমে এলেও এভাবে লিঙ্গ নির্বাচনের পূর্বশর্তগুলো বাংলাদেশে আছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সন্তান জন্মদানের সময় লিঙ্গ নির্বাচন হয় কি না, তা বেশ কয়েকটি বিষয় দিয়ে দেখা হয়। এর মধ্যে একটি হলো ছেলের তুলনায় মেয়ের জন্মহারের অনুপাত।
লিঙ্গভিত্তিক সন্তান নির্ধারণ নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বেল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, যদি দেখা যায় যে ১০০ মেয়ের বিপরীতে ১০৫টার বেশি ছেলেসন্তান থাকে, তবে এটি ঘটছে বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই অনুপাত ১০৭। অর্থাৎ ১০০ ছেলের বিপরীতে ১০৭ মেয়ে হলে ধরে নেওয়া যায় যে সন্তান জন্ম ইচ্ছাধীন হচ্ছে বা জেন্ডারভিত্তিক লিঙ্গ নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই অনুপাত এখনো ১০৫। অর্থাৎ প্রতি ১০০ মেয়ের বিপরীতে জন্ম হয় ১০৫ ছেলেশিশুর।
কিন্তু অনুপাতের দিক থেকে সমস্যা না থাকলেও লিঙ্গ নির্ধারণে যে তিনটি পূর্বশর্ত আছে, সেগুলোর সব কটিই বাংলাদেশে উপস্থিত। সেগুলো হলো, ছেলেশিশুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব, উর্বরতার হার এবং প্রযুক্তির প্রাপ্যতা।
বাংলাদেশে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৪ অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৯ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে ছেলেসন্তানের প্রতি আগ্রহ আছে। এরপর পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের ২০১৮ সালের ঢাকা, সিলেট, রংপুর বিভাগে একটি জরিপে দেখা গেছে, এর পরিমাণ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অধ্যাপক বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘এটি সারা বাংলাদেশের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল না।’
এবার আসা যাক উর্বরতার বিষয়ে। আমাদের দেশের জন্মদানের উর্বরতা কমেছে, এখন এটি ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সন্তান নেওয়ার আগ্রহ কমেছে। তবে এই প্রবণতার ফলে লিঙ্গ নির্ধারণে আগ্রহ বাড়ে। কারণ, সন্তান কম জন্ম দিতে গিয়ে ছেলেসন্তানের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকছে।
লিঙ্গ নির্ধারণের আরেকটি উপায় হলো, সন্তানের লিঙ্গ সম্পর্কে ধারণা পেতে প্রযুক্তির প্রাপ্যতা। এখন উপজেলা পর্যন্ত আলট্রাসনোগ্রাফির সুবিধা আছে।
পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ শতাংশ নারী তাঁদের গর্ভাবস্থায় সন্তানের লিঙ্গ জানার চেষ্টা করেন। অধ্যাপক বেল্লাল বলেন, এটা এখনো নির্ণয় করা যায়নি যে নেহাত কৌতূহল না গর্ভপাতের জন্য তাঁরা এই পরীক্ষা করিয়েছেন।
ছেলেসন্তান পছন্দের মূলে আর্থসামাজিক কারণ কাজ করে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত—দুই সমাজেই ছেলের প্রতি আগ্রহ বেশি। সম্পন্ন পরিবারগুলো সম্পত্তির উত্তরাধিকার ছাড়াও নির্ভরতার জন্য ছেলে পছন্দ করে। নিম্নবিত্তের মানুষেরা ছেলে পেতে চায় ভবিষ্যতের তাদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য। এখানেই সম্পত্তিতে সমানাধিকারের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত করতে পারলে পরিস্থিতির অনেকটা কিছুটা উন্নতি হতে পারে। আর দরকার বৃদ্ধদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা। যেটি একেবারেই অনুপস্থিত আমাদের দেশে।’
এই আর্থসামাজিক কারণের পাশাপাশি সেকেলে ধারণা ও নিরাপত্তাকে কারণ বলে মনে করেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা। তাঁর কথা, ‘আমাদের বেশির ভাগ বাবা-মা মেয়েকে ঘিরে কোনো স্বপ্ন দেখেন না। মেয়েকে ঘিরে তাঁদের স্বপ্ন বিয়ে পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এর মধ্যেই মেয়ের ভবিতব্য এবং সুরক্ষা খোঁজেন তাঁরা। আর এর পেছনে কাজ করে নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতা। মেয়ের স্বাধীন সত্তা এখনো স্বীকৃত না।’
বাংলাদেশে শ্রম শক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চলনশক্তি তৈরি পোশাক খাতে ৩০ লাখের কাছাকাছি নারী জড়িত।
ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, ‘মেয়েরা জীবনের লড়াইয়ে কী অসামান্য ভূমিকা রাখতে পারে, এ ধরনের উদাহরণ তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারে নামতে হবে। টিকাদান বা মেয়েশিশুকে স্কুলে পাঠানোর প্রচার সফল হয়েছে। আর এই সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি চাই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সংস্কার।’
রাজধানীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বললেন, ‘আমি বাবা–মায়ের চার নম্বর মেয়েসন্তান। আমার জন্মের পর আমার বাবা আমাকে হাসপাতালে দেখতেও যাননি। যা–ই হোক, তিনি আমাদের চার বোনকেই পড়াশোনা করিয়েছেন। বৃদ্ধ বাবা-মাকে আমরাই আগলে রাখছি।’