Saturday,25,January,2025
17 C
Dhaka
Saturday, January 25, 2025
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিলোক সাহিত্যজগতের আনন্দযজ্ঞ ও হুমায়ূন আহমেদ

জগতের আনন্দযজ্ঞ ও হুমায়ূন আহমেদ

জীবনের অসম সমীকরণ মিলে যায়। জটিলতা-কুটিলতা ফিকে হয়ে যায়। দুঃসহ স্মৃতি ও ব্যথা-বেদনা মুহূর্তে হয়ে যায় নিঃশেষ। যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা লাইনটি মনে পড়ে, ‘মনেরে আজ কহ যে/ ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।’ সত্য যত কঠিনই হোক, তা মেনে নিয়ে বেঁচে থাকার নামই তো জীবন। আর সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ সেই জীবনই তালাশ করেছেন জীবনভর। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেছেন, পাঠককে সেই একই কথা বলেছেন, ‘বেঁচে থাকাটাই আনন্দের, সেটা যেভাবেই হোক না কেন।’ এভাবেই আনন্দযজ্ঞে চলাফেরা ছিল তাঁর।

জনতা কিংবা নির্জনতার মধ্যে থেকে হুমায়ূন আমৃত্যু আনন্দের অনুসন্ধান করে গেছেন। বলেছেন, ‘জনতার মধ্যেই আছে নির্জনতা, আমার অনেক অনুসন্ধানের মধ্যে একটি হলো নির্জনতার অনুসন্ধান।’ অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক জোগাতে একদিন দুম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে মন দিলেন পুরোদমে লেখালেখি ও সিনেমা নির্মাণে। এখানে তিনি খুঁজে পেলেন স্বস্তি আর সৃষ্টির বিস্ময়কর আনন্দ।

প্রকৃতি ও জীবনকে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন লেখক হুমায়ূন। সেই পর্যবেক্ষণের আস্বাদিত স্বাদ পাঠক ও দর্শকদের বিলিয়ে গেছেন অকাতরে। শুধু রাত, চাঁদ, জোছনা ও বৃষ্টি উপভোগ নয়; হারানোর বেদনা বা বিষাদ উদ্‌যাপনের দৃশ্যায়নও করেছেন তিনি। বৃক্ষেরও যে সুখ-দুঃখ আছে, নিজস্ব ভাষা আছে; এই দাবি তুলে গেছেন তিনি। মানুষের ভাষা যেমন বৃক্ষ বোঝে না, তেমনি বৃক্ষের ভাষাও আমরা বুঝি না। আরও বলেছেন, পৃথিবীতে মায়ার ফাঁদে আটকে না থাকতে।

সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি ও রহস্যের প্রতি হুমায়ূনের ছিল অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে জীবদ্দশায় অনেক রহস্যই ভেদ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। আবার এটাও স্বীকার করেছেন, বিধাতার সব রহস্য উন্মোচনের ক্ষমতা মানুষের নেই। একই সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার বিষয়ে মিসির আলির বয়ানে লিখেছেন, ‘আমার ধারণা, সৃষ্টিকর্তা দুটো জিনিস পারেন না, যা মানুষ পারে। সৃষ্টিকর্তা নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না। মানুষ পারে। আবার সৃষ্টিকর্তা দ্বিতীয় একজন সৃষ্টিকর্তা তৈরি করতে পারেন না। মানুষ কিন্তু পারে, সে সন্তানের জন্ম দেয়।’

হুমায়ূনের লেখা আমাদের প্রজন্মের তরুণদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে নাড়া দিয়েছে, তাড়িত করেছে নতুনভাবে ভাবতে। স্বভাবতই কারও ভালো, গঠনমূলক বা সৃজনশীল কাজের নেশা থাকাকে আমরা ইতিবাচক মনে করি, সমর্থন দিই। কিন্তু হুমায়ূনের কলমে উচ্চারিত হলো ভিন্ন ধাঁচের বাণী, ‘নেশা তো নেশাই, ভালো কাজের নেশাই হোক, আর খারাপ কাজে নেশাই হোক।’ সুতরাং অসহায় মানুষকে শুধু বারবার নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করাও হুমায়ূনদর্শনের বিরুদ্ধ। তাঁদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে কাজে লাগানোই উপযুক্ত বলে মনে করেন তিনি।আমাদের প্রজন্মের তরুণদের প্রেমে পড়া ও বিরহ বা ‘ছেঁকা’ সামাল দেওয়ার কলাকৌশলও তো শিখিয়ে গেছেন তিনি। কীভাবে ‘হিমুগিরি’ খাটিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, কীভাবে নিজেকে কৌতূহলী মানবে পরিণত করা যায়, সেসব তরুণেরা শিখেছেন হুমায়ূনের বই পড়ে।

আমাদের প্রজন্মের তরুণদের প্রেমে পড়া ও বিরহ বা ‘ছেঁকা’ সামাল দেওয়ার কলাকৌশলও তো শিখিয়ে গেছেন তিনি। কীভাবে ‘হিমুগিরি’ খাটিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, কীভাবে নিজেকে কৌতূহলী মানবে পরিণত করা যায়, সেসব তরুণেরা শিখেছেন হুমায়ূনের বই পড়ে। তাঁর বই পড়ে আমাদের তারুণ্য আরও বেশি রোমান্টিক ও ঝলমলে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিজের একটি ঘটনার কথা বলি: ছাত্রাবস্থায় একবার ক্যাম্পাসে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হলো। মেয়েটি জানাল তার নাম ‘মৌসুমী’। উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আমি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললাম, ‘তোমার নাম “মৌসুমী”! কী বলো, তুমি তো একাই তিনটে নাম দখল করে আছ?’ মেয়েটি বলল, ‘কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘“মৌ”, “সুমী” আর “মৌসুমী”।’ এমন জবাবে মেয়েটি হেসে কুটিকুটি, মনে হলো এমন চমৎকৃত সে জীবনেও হয়নি। এসব মজার মজার কথা বলার বিদ্যা তো হুমায়ূনের প্রভাবেই আমাদের মাথায় ঢুকেছে।

বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ ‘হিমু’ ও ‘মিসির আলি’ নামে যে দুই চরিত্র রেখে গেছেন, এখনো এই দুই চরিত্র মানুষ তাঁদের হৃদয়ে ধারণ করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, হিমুর মাধ্যমে তরুণদের কাছে এবং মিসির আলির মাধ্যমে যৌক্তিক ও পরিণত মানুষদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকবেন হুমায়ূন। সেই সঙ্গে শিশুদের জন্য ভূত-প্রেতের গল্প লিখেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। ভূত বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, ‘পৃথিবীতে ভূত নেই, কিন্তু ভূতের ভয় আছে। আমি ভূত বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভূতের ভয় বিশ্বাস করি।’ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে রসিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন এই লেখক। সেই রসবোধ ছড়িয়ে আছে তাঁর সাহিত্যের পরতে পরতে।

আদতে সারা জীবন আনন্দের অনুসন্ধান করেছেন হুমায়ূন। এভাবেও বলা যায়, জগতে, আমাদের কাছে তিনি আনন্দ নিয়ে এসেছিলেন। জগতের এই আনন্দযজ্ঞে তিনি যেমন নিজে চিরকাল আনন্দকে উদ্‌যাপন করেছেন, তেমনি নিজের লেখনীর মধ্য দিয়ে পাঠককেও সেই আনন্দ-অভিসারে শরিক করেছেন। লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের বড় কৃতিত্ব বোধ করি এখানেই।

তৌহিদুল ইসলাম

সর্বশেষ