নতুন কথা রিপোর্ট: করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম দিকেই ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও গণটিকা কর্মসূচি শুরু করে। কিন্তু একটি উৎসের উপর অতি নির্ভরতার কারণে এখন সঙ্কটে পড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ মাসের মধ্যেই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা না আসলে প্রায় দশ লাখ মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবে না। একই সঙ্গে প্রথম ডোজ নেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও তাও বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার অবশ্য প্রথম দিকে উদ্বিগ্নহীন থাকলেও এখন অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে উদ্যোগী হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছাড়াও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। সর্বশেষ খবর অনুসারে সরকার ইতোমধ্যে রাশিয়ার সাথে স্পুটনিক-ভি টিকার জন্য চুক্তি করেছে। রাশিয়ার ঐ টিকার ফর্মুলা অন্য কাউকে দেয়া হবে না এই শর্তে বাংলাদেশকে ঐ টিকা উৎপাদনের অনুমতি দেবে বলেও জানিয়েছে। সরকার টিকার ব্যাপারে যে চীনকে এড়িয়ে গিয়েছিল সেই চীনের উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার টিকা ভাÐার গড়ে তুলতে দেশীয় একটি উদ্যোগে শামিল হতে রাজী হয়েছে। এই উদ্যোগে ভারত নাই। তবে সরকার এখানে কতখানি স্থির থাকবে তা বলা যায় না। কারণ ভারত তাদের দেশের তীব্র করোনা সংকট কোনোভাবে উতরাতে পারলে বাংলাদেশে তাদের টিকার আধিপত্য ছাড়তে চাইবে না। ভারতের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি দিল্লী সফর করে ফিরে এসে বলেছেন যে, ভারত তাদের কথা অনুসারে বাংলাদেশে শিগ্রী টিকা পাঠাবে। বাংলাদেশে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের টিকা সরবরাহকারী বেক্সিমকো জানিয়েছে এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত এ সংকট চললেও জুন নাগাদ তার অবসান হবে।
বাংলাদেশ টিকা সরবরাহ নিয়ে যে এই বিব্রত অবস্থায় পড়তে পারে তা অদৃষ্টপূর্ব ছিল না। টিকা সরবরাহের শুরুতে মোদীর টিকা কূটনীতির বদৌলতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত থেকে উপহার হিসেবে বিশ লাখ ডোজ টিকা পায়। এর মধ্যে প্রথম চালানের পঞ্চাশ লাখ ডোজ টিকা এসেও যায়। ভারত সেখানেই থেমে থাকে নি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মোদী বাংলাদেশে এলে আরো বারো লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন। ভারতের সেনাবাহিনী প্রধানও তার ঢাকা সফরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধানকে এক লাখ ডোজ টিকা উপহার দেন। কিন্তু গোল বাঁধে দ্বিতীয় চালানে। সেখানে চুক্তি অনুযায়ী মাসে পঞ্চাশ লাখ ডোজ টিকার জায়গায় সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ লাখ ডোজ সরবরাহ করে। টিকা সরবরাহকারী মধ্যস্থাকারী বেক্সিমকো বারবার আশ^াস দিলেও আর টিকা আসে নি। এখন বেক্সিমকো’ই সরকারকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা দিল্লীর বাংলাদেশ মিশন কেউ’ই দিল্লী কর্তৃপক্ষের কাছে হালে পানি পাচ্ছে না।
বিশ^ব্যাপী করোনা সংক্রমণ নিয়ে রাজনীতি ব্যাপারটি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পরায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলে অভিহিত করেন। কেবল তাই নয়, চীনের বিরুদ্ধে করোনা সংক্রমণের তথ্য গোপন করার অভিযোগও আনেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমঘেষা আরো কয়েকটি দেশ। কিছু বিজ্ঞানীরা একে চীনের ল্যাবরেটরী থেকে উৎপন্ন বলেও দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থাকে চীনের প্রতি পক্ষপাতপূর্ব বলে তা থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলে।
চীন অবশ্য এই দোষারোপের রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই বিশ^ মহামারী মোকাবেলা করার আহŸান জানায়। চীনকে এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশে^র বিভিন্ন দেশের দাবি অনুসারে বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার নেতৃত্বে এই করোনা ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে আন্তর্জাতিক তদন্ত করার দাবি মেনে নিয়ে ঐ তদন্ত কাজে সহায়তা করে। বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার তদন্ত কমিটি ওই ভাইরাস ল্যাবরেটরি থেকে ছড়িয়েছে বলে কোনোকিছু পায় নি। বরং চীন যে দ্রæততা ও দক্ষতার সাথে ওই করোনা সংক্রমণকে মোকাবিলা করেছে তার প্রশংসা করেছে। এখানে উল্লেখ করার বিষয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপের দেশসমূহ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও চীন, ভিয়েতনাম, কিউবাতে ঐ সংক্রমণ পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
বিশ^ব্যাপী এই করোনা পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে চীন পৃথিবীর দেশে দেশে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও ঔষধ পাঠায়। বাংলাদেশেও চীনের একটি প্রতিনিধিদল করোনা সংক্রমণ রোধে বেশ কয়েকদিন বিভিন্ন স্বাস্থ্য স্থাপনা ও সরকারি পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ সরকারকে একটি সুপারিশ প্রদান করে।
ইতোমধ্যে ভারত-চীন সীমান্তে সেনা সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তাতে বাংলাদেশকে পাশে পেতে ভারত তার করোনা কূটনীতি শুরু করে।
চীনের পাশাপাশি ভারতও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও ঔষধ বাংলাদেশে পাঠায়। তবে যে ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সুবিধাজনক জায়গা পায় তা টিকাকে কেন্দ্র করে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট পৃথিবীর সর্ববৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ড-এস্ট্রেমেনিকা তাদের টিকা উৎপাদন করতে এই অঞ্চলে ভারতের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। আর একে ভিত্তি করেই মোদী সরকার তার পাশর্^বর্তী দেশসমূহের সাথে তার সম্পর্ক উন্নত করতে এই করোনা টিকাকে ব্যবহার করা শুরু করে। এটা বর্তমানে মোদীর ‘ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসী’ নামে পরিচিত পেয়েছে। এই ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসীর অংশ হিসেবে ভারত বেক্সিমকোকে সিরাম ইন্সটিউটের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে সাহায্য করেÑযদিও বেক্সিমকো সম্পর্কে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল যে তারা পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ। কিন্তু রাজনীতি-কূটনীতির বিচিত্র খেলায় ঐ বেক্সিমকোই তাদের প্রধান সহায় হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারও ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সেরাম ইন্সটিটিউ ও বেক্সিমকোর চুক্তিকে সরকারি অনুমোদন দেয়।
এদিকে চীনের একটি ভ্যাকসিন বাংলাদেশে হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন চাইলে তা ঝুলিয়ে রাখা হয় কয়েক মাস। অন্যদিকে বাংলাদেশের গেøাবটেকও তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়ালের আবেদন করলে উচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের অনুমোদনের অপেক্ষায় পড়ে থাকে। বিএমআরসি-চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা টেলিভিশনে এ সম্পর্কে বলেছেন বিজ্ঞানীদের বাদ দিয়ে মুখ্যসচিব যখন সিদ্ধান্ত দেন তখন কি করা। জানা গেছে বিএসআরসি শেষ পর্যন্ত ঐ ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় নি। কোনো কারণও নাকি জানায় নি।
বাংলাদেশের জনগণ ভারতের এই টিকা কূটনীতির প্যাঁচে পড়ে পরিণাম ফল হিসেবে এখন টিকা পাবে কিনা তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারতে করোনা সংক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করায় সে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো মোদীর এই টিকা কূটনীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। ভারতের সংক্রমণের ভেরিয়েন্ট এখন যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে সে সব দেশ ভারত থেকে গমানগমন নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশেও ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর ঐ টিকা সংকট অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জনগণের কি অবস্থা দাঁড়াবে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সমীক্ষা বলছে, এস্ট্রেজনিকার এক বা দু’ডোজ যারা নিয়েছে তারা সংক্রমিত হলেও ৯৭% মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ছে না। এখন টিকা না পেলে ঐ মৃত্যু ঝুঁকি আরো বেড়ে যেতে পারে। করোনা নিয়ে বিশ^ রাজনীতি কম হয় নি। তাতে বরং বিশে^ আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। আর টিকা কূটনীতি সেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর আশঙ্কা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিল।