বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর প্রায় ১১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত। ১ নভেম্বর এ নদীর সুরক্ষার জন্য ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের ডাকে তিস্তার দু’তীরে ২৩০ কিলোমিটার মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। তিস্তা নদীর প্রবেশ মুখ বাংলাদেশের নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই জিরো পয়েন্ট থেকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর ঘাট (এখানে তিস্তা ব্রহ্মপুত্রে মিলেছে) পর্যন্ত মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণকালের সর্বোবৃহৎ এই মানববন্ধনে তিস্তার দুই পাড়ে লাখো মানুষের ঢল নামে। সারাদেশে অতীতে এত বড় মানববন্ধন হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। নদীর জন্য যে এত বড় মানববন্ধন হয় নি একথা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। কেন করলাম এই মানববন্ধন তার সংক্ষিপ্ত যুক্তি তুলে ধরছি। ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ ২০১৫ সাল থেকে সাংগঠনিকভাবে নদীর জন্য কাজ করছে। ২০১৫ সালে আমরা ‘তিস্তা কনভেনশন’ করেছি, যা দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তিস্তা-তীরবর্তী মানুষদের নিয়ে অতীতেও আমরা তিস্তার তীরে তীরে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করেছি। নদী ভাঙনের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে, মরা নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় ও পুকুর দখলমুক্ত করতে সংগ্রাম করেছি। সংগ্রাম করেছি তিস্তাসহ এর শাখা নদ-নদী থেকে এক্সক্যাভেটর, লোকাল ড্রেজারে বালু ও পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে। রিভারাইন পিপলসহ তিস্তার দুই তীরে অনেক সংগঠন তিস্তা বাঁচাতে নদী বাঁচাতে সংগ্রাম-আন্দোলন করছে।
তিস্তা নদী নির্ভর রংপুর বিভাগের কৃষি-অর্থনীতি। এ অঞ্চলের সাংষ্কৃতিক পরিমÐলেও রয়েছে তিস্তার অমোঘ প্রভাব। যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবেও সমৃদ্ধ ছিল তিস্তা। এ নদী গভীর ধারায় বহমান ছিল। গভীরতাও যেমন অনেক ছিল তেমনি প্রস্থে ছিল প্রায় দুই কিলোমিটার। পূর্বের দুই কিলোমিটার নদী ভাঙতে ভাঙতে আজ প্রায় ১২ কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে। তিস্তার দুপাড়ে বিস্তৃত চরাঞ্চলের কৃষি এখন কৃষির “হিডেন ডায়মন্ড”। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার শক্তিশালী বলয়। খরা, বন্যা ও নদী ভাঙনে তিস্তা-পাড়ের কৃষি বিপন্ন। কৃষক, মুটে, মজুর, মাঝি আজ দিশেহারা, ঘরহারা। আগেকার দুই কিলোমিটার তিস্তা আর বারো মাসী নদী নেই। তিস্তার তলদেশ ভরাট হয়েছে। তিস্তায় কোনো নাব্যতা নেই। শুকনো মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে এপার-ওপার চলাচল করে।
তিস্তার উজানে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে। এটি আন্তর্জাতিক নদী আইনে স্পষ্টত লঙ্ঘন। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে আর পানি থাকে না বললেই চলে। তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে সামান্য পানিতেই দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা আর বৃষ্টি থেমে যাওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই নদী শুকিয়ে কাঠ। এর চরম নেতিবচাক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। বর্ষার সময়ে বন্যা এবং ভাঙনে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকার কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলোতে আগাম পানিতে টান পড়ে। ফলে সেগুলোও দ্রæতই শুকিয়ে যায়। বিরান ভুমিতে পরিণত হয় খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয়। ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। জেলে মাঝিরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। কোটি কোটি টাকার মাছের উৎস বন্ধ থাকে। বর্ষাকালে ভারতের গজল ডোবা বাঁধের সব জলকপাট খুলে দেয়া হয়। ফলে বাড়ছে ভয়াবহ বন্যা, সৃষ্টি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। স্থায়ী জলাবদ্ধতায় নদী অববাহিকার পাশাপাশি গোটা রংপুর বিভাগের নিম্নাঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। উষ্ণতার কারণে বরফ গলে সাগরে পড়ছে। সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে। ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস ও বন্যার প্রকোপ বাড়ছে। সাগরের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি উপকুলীয় জেলায়। রংপুর বিভাগসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে জনজীবন বিপর্যস্ত, লÐভÐ। গত মাসেও বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ছিল পানির নিচে। তিস্তা অববাহিকাসহ সব নদী অববাহিকার মানুষ ৫ মাস ধরে পানিবন্দি ছিল। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে এবার। রংপুরে হয়েছিল স্মরণাতীতকালের রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি, ৪৪৭ মিলিমিটার। প্রায় ১০০ বছরেও রংপুরের মানুষ এত ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হননি। বুক পানিতে ডুবে ছিল বিভাগীয় শহর রংপুর। এবার ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশে এর অভিঘাত সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য উন্নতশীল দেশগুলো বেশি দায়ী। বাংলাদেশের একার পক্ষে বৈশি^ক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এজন্য বৈশ্বিকভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিজ দেশীয় চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি। তিস্তা নদী জলশূন্য হলে তিস্তার সাথে সাথে এর শাখা নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। অতিবর্ষণের জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ভাঙনের কারণে পরিবেশের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। এ কারণেও আমাদের তিস্তা নদীর সুরক্ষা সবার আগে জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তের বিরুপ প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে শুধু তিস্তাই না তিস্তার শাখা-প্রশাখা-উপশাখার খনন এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের সব নদীর সুরক্ষা জরুরি। জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতার অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে।
আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনায় একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। এই নদী ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত তথ্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। আমরা আশাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নদীবান্ধব-নদীতীরবর্তী গণমানুষ-বান্ধব মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছিÑনদী খনন করা হবে, রিভার চ্যানেল থাকবে। স্থান বিশেষে সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটারে আনা হবে নদীর প্রস্থ। উদ্ধারকৃত জমিতে কৃষির উন্নতিসহ জনকল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হবে। আমরা তিস্তা নদীর সুরক্ষা চাই। তিস্তার জীববৈচিত্র রক্ষা হোক এ আমাদের প্রত্যাশা। তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা বলতে আমরা শুধু নদীর পানির কথা বলছি না। তিস্তাকে ঘিরে জীববৈচিত্র্য, তিস্তা নির্ভর মানুষের জীবন, তিস্তা অববাহিকার ব্যবস্থাপনাও আছে এর মধ্যে। এই ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা গেলে রংপুর বিভাগীয় নগরীসহ সংশ্লিষ্ট জেলাগুলো জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা মরতে বসেছে। আমরা মনে করি, এখনো তিস্তাকে তার যৌবনে ফেরানো সম্ভব। অতীতের সৌন্দর্যে তিস্তাকে আবার প্রবহমান করা যাবে। নদীর বিজ্ঞানসম্মত খনন, তীররক্ষা, শাখানদীগুলো উন্মুক্তকরণ, শাখা নদী খনন করা জীবনের স্বার্থেই অপরিহার্য। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণও করতে হবে। নদী-তীরবর্তী কৃষিব্যবস্থাপনা, সমবায়ী কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে পেতে হবে। সেজন্য তিস্তা চুক্তির কোনো বিকল্প আমাদের নেই। তিস্তার দুপাড় ভালোভাবে বাঁধানো গেলে ভাঙনের হাত থেকে ৫ জেলার নদীর তীরবর্তী মানুষ নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। তিস্তা চুক্তি অপরিহার্য। তালিকাভুক্ত ৫৪টি নদীসহ বাংলাদেশ-ভারত সব অভিন্ন নদীকে অঞ্চলভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা। অঞ্চলভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনায় ভারত, চীন ও নেপালকে যুক্ত করা।
লেখকবৃন্দঃ যথাক্রমে সভাপতি তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও রিভারাইন পিপল-এর পরিচালক।