Saturday,7,December,2024
19 C
Dhaka
Saturday, December 7, 2024
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতদলবদল নয়, দিনবদল

দলবদল নয়, দিনবদল

।। শান্তনু দে ।।

শান্তনু দে

বামপন্থীরা বলছেন বিকল্পের কথা। বিকল্পের দাবিতে যে সংগ্রাম, বিকল্প সরকার হলে তার বাস্তবায়ন। বিকল্পের সংগ্রামে, বিকল্প সরকারের লক্ষ্যে মুখ্য স্লোগান: কাজ, কর্মসংস্থান। এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে দলবদলের হিড়িক। সকালে তৃণমূল। বিকেলে বিজেপি। একই উঠোনের দুই দালান। তৃণমূলের প্রাক্তনীদের নিয়ে গঠিত বিজেপি’র রাজ্য কমিটি। আর তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে বিজেপি’র গন্ধ। বিজেপি’র সবচেয়ে বড় সাপ্লাই লাইন তৃণমূল। রাতারাতি তৃণমূলের দলীয় দপ্তরে বিজেপি’র ব্যানার। সন্ধ্যায় চ্যানেলে-চ্যানেলে তার মুখরোচক খবর। সকালের দৈনিকে পাতাজোড়া শিরোনাম। দলবদলের তরজা।
আর দলবদলের এই বাহারি প্রচারের আতিশয্যে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা। দিনবদলের কথা।
রাজ্যের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। গত ৯ বছরে এই সরকার নতুন করে ধার নিয়েছে ২ লক্ষ ৪৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের মাথায় ধার এখন ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই ধারের অর্থ দিয়ে কী করেছে সরকার? পরিকাঠামো উন্নয়ন? রাস্তা-ঘাট-পানীয় জল-সেচ-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বানাবার জন্য কি এই অর্থ খরচ করেছে? এক কথায়-না। তাহলে কী রেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, কৃষকদের ফসল উৎপাদনের দেড়গুণ দাম নিশ্চিত করেছে, অথবা অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বার্ধক্য ভাতার পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়িয়েছে? না, তাও নয়। টাকার অভাবে বাড়েনি রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা। বাড়েনি বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতাও। বেকারদের অবস্থা ভয়াবহ। ঝাঁ চকচকে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল রয়েছে, টাকার অভাবে হয়নি সরঞ্জাম কেনা। হয়নি পরিকাঠামো নির্মাণ। কিংবা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ। হয়নি জেলায় জেলায় প্রাইমারি স্কুলের সম্প্রসারণ। হয়নি সেতু মেরামত।
তাহলে কী করেছে এই অর্থ দিয়ে? বেপরোয়া সরকারি অর্থ লুঠ। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের থেকে নীল সাদা রঙ কেনা। ক্লাবে-উৎসবে দেদার টাকা ওড়ানো। ইমাম-মুয়াজ্জিন-পণ্ডিতদের অনুদান। আজ মাটিমেলা, কাল সমুদ্রমেলা, পরশু পিঠেমেলা-এই হলো সরকারের কাজ।
এই সময়ে রাজ্যে একটা কারখানা নতুন করে হয়নি। উলটে বাম আমলে তৈরি বহু কারখানা বা কোম্পানি তোলাবাজির অত্যাচারে রাজ্য থেকে চলে গিয়েছে। গ্রামে রেগা প্রকল্পের টাকা লুঠ হচ্ছে, গরির মানুষ কাজ পান না। লক্ষ কোটি বেকার কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন। তাদের বাবা-মা-স্ত্রী- সন্তান পথ চেয়ে বসে আছেন। রাজ্যে নিয়োগ বন্ধ স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুর্নীতির জন্য হাইকোর্টের রায়ে আপার প্রাইমারিতে মেধা তালিকা সম্পূর্ণ বাতিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পঙ্গু করে হয়েছে নতুন বোর্ড। যা সংবিধান সম্মত নয়। দুর্নীতি, নৈরাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে। হয়নি ক্লার্কশিপ পরীক্ষা। তাহলে কোথায় হবে কর্মসংস্থান? রাজ্যে বেড়েই চলেছে শূন্যপদের সংখ্যা। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে লক্ষাধিক। কলেজে স্থায়ী অধ্যাপকের শূন্যপদ ২৫ হাজারের বেশি। সরকারি-আধা সরকারি মিলিয়ে শূন্যপদ কমবেশি সাড়ে ৫ লক্ষ।
বামপন্থীরা বলছেন বিকল্পের কথা। বিকল্পের দাবিতে যে সংগ্রাম, বিকল্প সরকার হলে তার বাস্তবায়ন। বিকল্পের সংগ্রামে, বিকল্প সরকারের লক্ষ্যে মুখ্য স্লোগান: কাজ, কর্মসংস্থান। এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। কাজ দিতে না পারলে ভাতা। সরকার ও আধা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সমস্ত শূন্যপদ এক বছরের মধ্যে পূরণ। কর্মসংস্থানের মূল তিনটি ক্ষেত্র কৃষি, শিল্প ও পরিষেবায় কাজের সুযোগ বাড়ানো। জরুরি হলো চাষের খরচ কমিয়ে, কৃষকের কাছে ফসলের দাম বাড়িয়ে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে শ্রমদিবস বাড়িয়ে ও শহরে তা সম্প্রসারিত করে কর্মসংস্থান বাড়াানো। সমবায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও করোনার সময়ে সংগঠিত কমিউনিটি কিচেন, সবজি বাজার ইত্যাদি স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে প্রসারিত করা। অতীতের বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের মতো ফি বছর টেট, এসএসসি, পিএসসি’র মাধ্যমে নিয়োগ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ। ছোট-মাঝারি শিল্পে সরকারি সহায়তা, বিনিয়োগ। বামফ্রন্টের সময় ছোট-মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান ছিল রাজ্যগুলোর মধ্যে শীর্ষে। অনেক পিছনে গুজরাট। এখন সবই সঙ্কটে। বেশিরভাগই বন্ধ। সিঙ্গুরে নব্বই শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা তাড়ানোর পর আর বিনিয়োগ আসে নি। জিন্দাল ইস্পাত কারখানা পুরোপুরি বন্ধ। বছর-বছর শিল্প সম্মেলন হয়েছে। বিনিয়োগ হয়নি। রাজ্যের মজুরির হার দেশের তুলনায় বেশ কম। অবধারিত পরিণতি রাজ্য ছেড়ে শ্রমিকদের ভিন রাজ্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া। কেরালায় একজন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ৭০০ টাকা। আর ছুতোর, রাজমিস্ত্রির মতো দক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ১,০০০ টাকার ওপরে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে একজন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ৩২৯ টাকা, আর দক্ষ শ্রমিকের ৩৯৮ টাকা। কৃষি থেকে কৃষক উচ্ছেদ রোধে চাই পরিকল্পিত উদ্যোগ। ২০১৮-১৯, রাজ্যে কৃষিতে নিযুক্ত রয়েছেন ৩৪ শতাংশ কর্মরত মানুষ, ভারতের ক্ষেত্রে যে সংখ্যা প্রায় ৪৩ শতাংশ। আবার রাজ্য সরকার কৃষকদের ব্যাপক আয় বেড়েছে বলে দাবি করলেও আসলে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের আয় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই কম। অবধারিত পরিণতি কৃষকের অভাবী বিক্রি। আত্মহত্যা।
উন্নয়নের প্রাথমিক শর্তই হল-শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থায়িত্ব। ঐক্য বিনা সে শান্তি ও স্থায়িত্ব সম্ভব নয়। ঐক্যের ভিত্তিই হল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। তার মধ্যদিয়ে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সৌহার্দ্য। ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা এবং বিচ্ছিন্নতার সমস্ত প্রয়াসকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করবে-এমন সরকারই চায় মানুষ। বিভাজনের শক্তি তৃণমূল ও বিজেপি এ কারণে উন্নয়ন, শান্তি ও গণতন্ত্রের পথে বাধা।
আজ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে শক্তিশালী করতে হলে সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ এবং সর্বপ্রকার স্বেচ্ছাচারিতা ও একাধিপত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। বামপন্থীরাই এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বহু দশক ধরে অনতিক্রম্য বাধার পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাংবাদিকরা একবার জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার রাজ্যে দাঙ্গা কেন হয় না? বসুর সহজাত জবাব ছিল, আমার সরকার দাঙ্গা চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না। সরকার না চাইলে দাঙ্গা কখনোই হয় না। প্রবল প্রত্যয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলতেন, ‘দাঙ্গাবাজদের মাথা গুঁড়িয়ে দেওয় হবে’। সাম্প্রদায়িক শক্তি তাই মাথা চাডা দেওয়ার সাহস দেখায় নি।
রাজ্যের মানুষ বিকল্প খুঁজছেন।
মানুষ অতিষ্ঠ তৃণমূলের অত্যাচার আর লুঠের রাজত্বে। তৃণমূল, বাম-কংগ্রেস এবং বিজেপি-র মধ্যে ভোটের বিভাজন নিঃসন্দেহে নির্বাচনকে ত্রিমুখী করে তুলছে। কিন্তু তার মানে এই নয় তাতে বিজেপির কোনো সুবিধা হবে। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে এখন প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। হুমকি, সন্ত্রাস এবং পুলিশী দমন-পীড়নের কারণে বামপন্থীদের ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মী-সমর্থক রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তৃণমূলের শাসনের একদশকে তারা নিজেদের ঘরে ফিরতে পারেন নি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলেন। সমান সংখ্যক মানুষ জেলে, বা তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। তাছাড়া, কেন্দ্র ও রাজ্যের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে জনবিরোধী আর্থিক নীতি মানুষের অবস্থা করে তুলেছে অসহনীয়।
এই প্রেক্ষিতে, বাম-কংগ্রেস জোট না থাকলে তৃণমূলের বিপক্ষে যে একটি বড় অংশ রয়েছে, তা পুরোপুরি চলে যেত বিজেপি’র দিকে। সহজ করে দিত বিজেপি’র জন্য জয়ের রাস্তা। মানুষ এখন দেখছেন যে এই দুটি মেরুকরণকারী শক্তির বিরুদ্ধে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিকল্প রয়েছে। তৃণমূলের ওপর অসন্তুষ্ট মানুষের একটি বড় অংশ সমর্থন করবে বাম-কংগ্রেস জোটকে। সংখ্যালঘুরা, বুঝতে পেরেছেন তাদের বাস্তবিক উন্নতির লক্ষ্যে তেমন কিছুই করা হয়নি। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ও সংখ্যালঘু অংশের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিচ্ছিন্নতা। শেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে পরাস্ত করার তাগিদে তারা ভোট দিয়েছিলেন তৃণমূলকে। এখন এখানে রয়েছে একটি কার্যকর বাম-কংগ্রেস জোট।
নির্বাচনী লড়াইকে তৃণমূল ও বিজেপি’র মধ্যে আটকে রাখার জন্য তৎপর মিডিয়া। সেকারণে, একই খোয়াড়ে দলবদল নয়। খোয়াড় ভেঙে হোক দিনবদল। স্বৈরজমানার বদল।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, মার্কসবাদী পথ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তাত্ত্বিক পত্রিকা।

সর্বশেষ