দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে আর গরীবেরা হচ্ছে গরীবতর। তবে গরিবদের কেউ কেউ ধনী হচ্ছে। সেই তুলনায় ধনীদের দ্রুততম সময়ে আরও ধনী হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ পরিস্থিতি দূর করতে হবে। আর এখন উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এটা শুধু হলেই চলবে না, সেই অবস্থান ধরেও রাখতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আয়োজনে রোববার (২৪ মার্চ) সংস্থাটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক ইশতেহারের মোড়ক উন্মোচন: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রবণতা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে।
সেমিনারের প্রথম অধিবেশনে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রবণতার সারমর্ম: স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। তাঁর সঞ্চালনায় সেমিনারের এই পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ছিলেন বিশেষ অতিথি। এ ছাড়া আরও চারটি প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয় এ অধিবেশনে।
বিনায়ক সেন বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিনিয়োগের হারকে যে ৩২ থেকে ৩৪ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে, তা একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁর মতে, এখন দরকার হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করাসহ নয়টি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, অবহেলিত নগর দরিদ্রদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, বিদ্যালয়ে ও কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, কর-জিডিপির হার বৃদ্ধি, আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা ইত্যাদি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ কেন বাংলাদেশের পরিবর্তে ভিয়েতনামে যায়, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে বলে উল্লেখ করেন অর্থনীতির গবেষক বিনায়ক সেন।
সেমিনারে যেসব বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তেমন কিছুই বলেননি পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুস সালাম। তিনি শুধু লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সরকার কাজ করছে। যেসব সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি, সেগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কম-বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। সরকার কী চায় তা এতে বলা হয়েছে, তবে মানুষ কী চায়, তা–ও মনে রাখতে হবে। গণিত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে মসিউর রহমান বলেন, মাধ্যমিকে গণিতের যত শিক্ষার্থী থাকে, সেই সংখ্যা উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে কমতে থাকে। পরে আরও কমে।
বিজ্ঞান সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি না হলে এ বিষয়ে কেউ পড়বে না উল্লেখ করে মসিউর রহমান বলেন, অথচ স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞান পড়াটা খুবই জরুরি।
শুল্ক মওকুফের বিষয়টি গভীরভাবে দেখার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, দেখতে হবে শুল্ক মওকুফে উৎপাদন বাড়ে কি না। শুল্ক মওকুফের এখতিয়ার কর কর্তৃপক্ষের আওতায় রাখার দরকার নেই বলেও মনে করেন তিনি।
জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমা এবং সেবা খাতের বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তাহলে বাংলাদেশ শিল্পবিমুখ হয়ে উঠছে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। ভ্যাট আদায় নিয়ে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। শামসুল আলম বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আদায় করুক। আর এসব বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করুক অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এতে আদায় ভালো হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও তেলের মূল্যবৃদ্ধি
মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, রিজার্ভ, চলতি হিসাব এবং ভঙ্গুর আর্থিক খাত নিয়ে চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মনজুর হোসেন বলেন, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত—উভয় মূল্যস্ফীতিই যখন ৯ শতাংশের বেশি, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে অনেক বিষয় সম্পর্কিত। ফলে মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দিতে হলে তেলের দাম কখন বাড়াতে হবে, সেই সময়টাকেও মাথায় রাখা উচিত। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি অর্জনের বড় নিয়ামক হচ্ছে আমদানি। অথচ দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি কম।
প্রবন্ধে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির পেছনে আরও যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহজনিত সংকট, বেঁধে রাখা সুদহারের সীমা ঠিক সময়ে প্রত্যাহার না করা, মুদ্রানীতি কার্যকর না হওয়া, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা এবং যথাযথ বাজার তদারকির অভাব।
দেশে বিনিময় হার অতি মূল্যায়িত ছিল বলে মনে করেন মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসকে (বিএবি) বিনিময় হার ঠিক করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। এটা দেওয়া কখনোই উচিত নয়। বর্তমানে মার্কিন ডলারের যে অনানুষ্ঠানিক দর রয়েছে, সেটাই বাজারদর বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আর্থিক খাত নিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, এখনো খেলাপি ঋণের হার অনেক বেশি। রয়েছে মূলধন ঘাটতি। বেসরকারি কিছু ব্যাংকের অবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হয়। কিছু ব্যাংকের ওপর তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে সংস্কারকাজ জরুরি। ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
ক্ষুদ্র কৃষকের টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন
বিআইডিএসের প্রফেশনাল ফেলো এম এ সাত্তার মণ্ডল ‘দেশের কৃষি খাতের রূপান্তর: ক্ষুদ্র কৃষক কি টিকে থাকবে’ শীর্ষক প্রবন্ধ তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, কৃষিজমি কমায় খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। খামারের আয়তন ছোট হতে হতে এমন পর্যায়ে আসছে যে এগুলোতে যন্ত্র ব্যবহার কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র কৃষক কীভাবে টিকবে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
চ্যালেঞ্জ হিসেবে বলা হয়, কৃষি উৎপাদনের ব্যয় বাড়ছে। কৃষকেরা পুঁজির অভাবে ঋণের জন্য যাচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর কাছে। সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ যে ভালো, তা এত দিন পর্যন্ত প্রমাণিতও হয়নি। এদিকে করপোরেট কোম্পানিগুলো আলু, ভুট্টা, সুগন্ধি চাল, ফল, মসলা, পোলট্রি, বীজ ইত্যাদি চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদে মনোযোগী। কৃষকেরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। ধান উৎপাদন খুব একটা লাভজনক নয়, তাই এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পাশাপাশি দরকার ভর্তুকি ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা।
সহজ শর্তে ঋণ চালু রাখা, ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি উৎপাদনে সহায়তা দেওয়া, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) ভিত্তিতে হিমাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন সাত্তার মণ্ডল।
ইশতেহারে লক্ষ্যমাত্রা ১১, দরকার ১৫-২০%
বিআইডিএসের ভিজিটিং ফেলো সৈয়দ মইনুল আহসান মধ্য আয়ের করকাঠামো নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২৮ সালের মধ্যে জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের হার ১১ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা আছে। এটা এখনো ৮ শতাংশের নিচে। মধ্য আয়ের দেশের জন্য এ হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হওয়া দরকার।
কর-জিডিপির হার ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
মইনুল আহসান বলেন, দেশের কর প্রশাসনের সংস্কার দরকার। কর প্রশাসনে দুর্বলতা যেমন রয়েছে, আছে দুর্নীতিও। এখনো জিডিপির মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর। ২০২৩ সালে দেশের নতুন করদাতা যেখানে ১ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে ভারতে বেড়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
হাওরাঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বেশি
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সবার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প কারখানা বৃদ্ধি, ফসল উৎপাদনে বহুমুখিনতা, ২০২৮ সালের মধ্যে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন দেড় গুণে উন্নীত করা, মৎস্য উৎপাদন ২১ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এসব কথা উল্লেখ করে বিআইডিএসের আরেক গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ ইউনূস হাওরাঞ্চলের জীবনযাত্রার ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, অন্য অঞ্চলের তুলনায় হাওরাঞ্চলের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বেশি। বছরের একটা সময়ে এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য অংশের কোনো কাজও থাকে না। তাদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের সুযোগ কম।
প্রবন্ধে বলা হয়, হাওরাঞ্চলের মানুষের আয়বৈষম্যও বেশি। তাঁরা ব্যাংকঋণও কম পান। এ অঞ্চলের মানুষদের দেশের অন্য এলাকায় কাজ করতে যাওয়ার উদাহরণও বেশি।