নতুন কথা’র কথা
জনগণের সংগ্রামের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘নতুন কথা’র যাত্রা শুরু হয়েছিলো কিংবদন্তী বিপ্লবী প্রয়াত কমরেড অমল সেন -এর হাত ধরেই। ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম সংখ্যাটির প্রথম পাতায় কমরেড অমল সেন “নতুন কথা’র কথা” শিরোনামে এই বিশেষ সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন। ‘নতুন কথা’র গৌরব ও সংগ্রামের ৪২ বছরের যাত্রার এই শুভক্ষণে কমরেড অমল সেন এর লেখা সেই সম্পাদকীয় টি পাঠকদের জন্য আবারো প্রকাশ করা হলো।
।। অমল সেন ।।
‘নতুন কথা’ প্রকাশিত হলো। ‘নতুন কথা’ নতুন কিছু নয়। কথার শাশ্বত রূপ যা শত শত বছরের বিকৃতির জঞ্জালে চাপা পড়ে আছে, নতুনভাবে তারই আত্মপ্রকাশ এই ‘নতুন কথা’। সৃজনশীল সমবেত শ্রমই একদিন কথার জন্ম দেয়। কথা সামাজিক শ্রমের সহজাত এবং অপরিহার্য সহযোগী। শ্রমের সৃজনশীল হয়ে ওঠার জন্যই সামাজিক শ্রম সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন উৎপাদনের উপায় বা উৎপাদন-যন্ত্র, আর সৃষ্টি করেছে কথাকে। শ্রমকে সম্পদে রূপ নিতে হলে উৎপাদন-যন্ত্র যেমন অপরিহার্য, তেমনই প্রয়োজন কথার। কথাÑ উৎপাদনের অন্যতম উপায়।
আজ আমাদের এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, উৎপাদনের উপায়গুলোর সামাজিক চরিত্রকে এক নিষ্ঠুর জবরদস্তিতে, উল্টো করে ব্যবহার করা হচ্ছে। উৎপাদনের উপায়গুলোকে উৎপাদক শ্রমজীবীর হাত থেকে ব্যক্তি-মালিকানায় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। উৎপাদনের এই উপায়গুলো আজ উৎপাদক শ্রমজীবীদের শ্রমের ফসলকে লুণ্ঠন করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আর তাই তো দেখা যায় আজ কথার শাশ্বত রূপটা হারিয়ে গেছে। বিকৃত কথার ফুলঝুরি আজ উৎপাদক শ্রমজীবীদের শোষণ করার এই সমাজ ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখার কাজে শোষকদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। তবুও এটাই শেষ সত্য নয়। এখানেও, এই মুহূর্তে, ব্যাপক শ্রমজীবী জনগণের আগ্নেয়গিরি-বুকে, জীবনের এক সামগ্রিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আগুন ধূমায়িত। ‘নতুন কথা’ এই অব্যক্ত বিক্ষোভেরই এক নির্ভীক বাণীরূপ।
শোষণ, বঞ্চনা আর পীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমজীবী জনগণের সামনে মুক্তিদাতার হরেক রকমের আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে এসে দাঁড়িযেছেন হরেক রকমের নেতা, পার্টি আর রাষ্ট্রনায়ক। মুক্তি মেলেনি, মিলেছে অধিকতর যন্ত্রণা। এই মুহূর্তেও, যেসব পার্টি, নেতা বা রাষ্ট্রনায়ক জনগণকে মুক্তি এনে দেয়ার কথা বলছেন, সেসব কথা যে মিথ্যা কথা, সেসব কথা যে ছলনার কথা, তা জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় শ্রমজীবী জনগণের উপলব্ধিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে চাইছে। ‘নতুন কথা’ এই নতুন উপলব্ধিরই যৌক্তিক পদক্ষেপের কথা বলবে। -বলবে, শ্রমজীবী জনগণকে তাঁদের জীবন-জীবিকার সচেতন শ্রেণী সংগ্রাম ও সংগঠনের ধারায় গড়ে তুলতে হবে তাঁদের নিজস্ব শক্তিকে; -বলবে, এইসব সংগ্রামের মধ্যদিয়েই জনগণকে সৃষ্টি করতে হবে তাঁদের নিজস্ব নেতৃত্ব; Ñ বলবে, এইসব নতুন ধরনের নেতৃত্ব ও শক্তির উপর দাঁড়িয়ে জনগণকে ছিনিয়ে নিতে হবে উৎপাদন, বণ্টন আর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে, জয় করে নিতে হবে নিজেদের মুক্তিকে। যেসব রাজনৈতিক সংস্থা নিজেদের জনগণের স্বার্থের পক্ষে বলে দাবি করেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে ‘নতুন কথা’ হয়ে উঠবে প্রতিক্ষণের হুশিয়ারি। -জনগণকে, জনগণের জীবন-জীবিকার শ্রেণীসংগ্রামগুলোকে তাঁদের শ্রেণী বা পেশাগত সংগঠনগুলোকে নিজ নিজ পার্টির অনুগামিত্বে নিয়ে আসার ভ্রান্ত চেষ্টায় সংশ্লিষ্ট জনগণের ঐক্যকে বিখণ্ডিত করে তোলা জনগণের স্বার্থরক্ষার পথ নয়; শ্রেণীসংগ্রামে ব্যাপকতম ঐক্য সৃষ্টিতে সাহায্য করা, সংগ্রামগুলোকে সার্থক হয়ে ওঠার সঠিক নির্দেশে সাহায্য করাই জনগণের স্বার্থের পথ। -যান্ত্রিকভাবে জনগণের ওপর নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা নয়; শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতি-সচেতন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সাহায্য করা। -শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বিতর্কের ফলপ্রসূহীন পথে নয়, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রেণীসংগ্রামে শামিল হয়েই বামপন্থী ঐক্যকে বাস্তবায়িত করার পদক্ষেপ নেয়া। -নিজের পার্টিকে জনগণের স্বার্থের প্রতিভূ মনে করে, জনগণের সমর্থনে পার্টির ক্ষমতা দখলের পথ জনগণের মুক্তির পথ নয়; সচেতন ও সংগঠিত জনগণের নিজস্ব শক্তির কর্তৃত্বে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে আসা এবং পার্টির এই ক্ষমতার বিশ্বস্ত প্রহরী হয়ে ওঠাই জনগণের মুক্তির পক্ষে ভূমিকা পালন করা।
এই মুহূর্তে, এখানে, বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষ জীবন-জীবিকার সংগ্রামে পা বাড়াচ্ছেন। ‘নতুন কথা’ হবে এইসব জীবন-জীবিকার শ্রেণীসংগ্রামেরই কথা। জীবনের যে তিক্ত অভিজ্ঞতায় এইসব শ্রমজীবী মানুষ সরকার ও প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যায়বিচার ও ন্যায্য অধিকার উপঢৌকন হিসেবে পাওয়ার হোলাল ছিন্ন করে বার হয়ে আসছেন, যে মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতায় আজ তাঁরা বুঝছেন যে, চিরাচরিত ধরনের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো একটিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমে তাঁদের জীবনের সমস্যা মিটতে পারে না- ‘নতুন কথা’ হয়ে উঠবে জনগণের সেই নতুন অভিজ্ঞতার কথা। সে অভিজ্ঞতা যে বাস্তব পদক্ষেপের দিকনির্দেশ করে, তারই কথা।
‘নতুন কথা’ শ্রমজীবী জনগণের জীবন-জীবিকার শ্রেণীসংগ্রামের কথা। এ মুহূর্তে এইসব শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী বিভিন্ন অংশ। শ্রেণীসংগ্রামে সংশ্লিষ্ট জনগণের ব্যাপকতম ঐক্যের স্বার্থে, রাজনৈতিক ছুঁৎমার্গের মানসিকতা যাতে শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, তার জন্য ‘নতুন কথা’র সংগ্রাম থাকবে অব্যাহত।
বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের এইসব সংগ্রাম আজও বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত আর স্বতঃস্ফূর্ত। অনেক ক্ষেত্রেই এ সংগ্রামগুলো ছিনিয়ে নিতে পারছে না তাদের আশু এবং আংশিক দাবিকেও। সংগ্রাম সামনে বাড়বার পথ হাতড়াচ্ছে। সুদূরপ্রসারী, সার্বিক এবং চূড়ান্ত যে লক্ষ্যের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারলে এই সংগ্রামগুলো সঠিকভাবে আগুয়ান হওয়ার পথ নিতে পারবে, ‘নতুন কথা’ হবে তারই বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর।
শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন পেশাগত শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য থেকে যে সমাজবিজ্ঞান-সচেতন নেতৃত্বগুলো গড়ে উঠবে, সেগুলোকে সমন্বিত করে, জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তিসংগ্রামের সার্থক নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করার জন্য বিকশিত হয়ে উঠতে হবে শ্রমজীবী জনগণের যে নিজস্ব রাজনৈতিক পার্টিকে, তারই কথা বলবে ‘নতুন কথা’।
শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব কর্তৃত্বে নতুন সমাজ সৃষ্টি করার কাজ চলছে যেসব দেশে, তাদের বিজয়গুলোতে অনুপ্রেরণা লাভ করার কথা, তাদের অগ্রগতিতে আগ্রহী হবার কথা, তাদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা, এই দেশের সংগ্রামরত মানুষের কাছে ‘নতুন কথা’ তুলে ধরবে। ঐসব দেশের পরস্পরের মধ্যকার ঐক্যের সপক্ষে এবং আত্মকলহের বিরুদ্ধে ‘নতুন কথা’ থাকবে উচ্চকণ্ঠ। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পীরবাদ বা গুরুবাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে অথবা কোনো দেশের নীতির অন্ধ অনুসরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে, এদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে প্রতিমুহূর্তে সচেতন করে তুলতে ‘নতুন কথা’ থাকবে শ্রান্তিহীন।
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার অথবা জাতীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিরক্ষার সংগ্রাম অথবা সাম্রাজ্যবাদ-সামন্ত অবশেষ, আমলা, মুৎসুদ্দি স্বার্থবিরোধী যে কোনো সংগ্রাম যে কেবলমাত্র জনগণের জীবন-জীবিকার শ্রেণীসংগ্রামের পথেই কার্যকর এবং সুনির্দিষ্ট হতে পারে- এই অমোঘ সত্যের দিকে প্রতিমুহূর্তে বলিষ্ঠ অঙ্গুলি নির্দেশ রাখবে ‘নতুন কথা’। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার নামে জীবন-জীবিকার শ্রেণীসংগ্রামগুলোকে বাতিল করার প্রতারণামূলক যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দীপ্ত প্রতিরোধে ‘নতুন কথা’ থাকবে বাঙ্ময়।
এই দেশের এতদিনকার রাজনৈতিক মঞ্চে জমিদারীর দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদারদের পারস্পরিক বিরোধে, লাঠিয়ালের ভূমিকায় নিযুক্ত থেকে আসছেন এদেশের শোষিত শ্রমজীবী জনগণ। এই পুরনো ধারার রাজনীতির পালাখতম আজ আসন্ন। আসন্ন নতুন ধারার রাজনীতির দীপ্ত অভ্যুদয়। আজই এ মুহূর্তে ‘নতুন কথা’ শোষিত শ্রমজীবী জনগণের নিজস্ব নেতৃত্বে নিজস্ব শক্তিতে নিজেদের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্তৃত্বকে জয় করে নেবার এই নতুন ধারার রাজনীতির আবির্ভাব ঘোষণার নকীব। আজকের এই মৃদুকণ্ঠ নকীব ‘নতুন কথা’ অতি আসন্ন আগামীতে হয়ে উঠবে এই নতুন ধারার দুর্মদ সংগ্রামের রণভেরী, আর অদূর ভবিষ্যতে জনগণের চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামের বিজয় ঘোষণার তোপধ্বনি। শ্রমজীবী জনগণের জন্যে নতুন দিনকে জয় করে নেয়ার কথা বলতে জন্ম নিল ‘নতুন কথা’।