দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে এখন দারুণ উত্তাপ। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনড় অবস্থান উস্কে দিচ্ছে রাজপথে সহিংসতার শঙ্কা। আন্তর্জাতিক মহলের বহুমাত্রিক তৎপরতার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা কিংবা সমাধানের তেমন কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। এতে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তারা বলছেন, দলগুলো নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি না করলে চলমান রাজনৈতিক সংকট দেশকে আবারও ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তবে বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শক্তির খুব একটা ভারসাম্য নেই। তাই সহিংসতা বা সংঘাতের তেমন শঙ্কা এখনও নেই। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছে। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও এমন তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারছেন না কেউ।
এমন অনিশ্চয়তার দোলাচলে সাধারণ মানুষের মনে নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে আগামী ২৮ অক্টোবর নিয়ে। ওইদিন ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ওইদিন থেকে চূড়ান্ত ধাপ শুরুর লক্ষ্য দলটির। অন্যদিকে বিএনপিকে প্রতিহত করে রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। দুই দলের এমন মুখোমুখি অবস্থানের কারণে আলোচনায় ফিরে এসেছে ১৭ বছর আগের আরেক ২৮ অক্টোবর। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে সেদিন যুক্ত হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংঘাতের এক কালো অধ্যায়। তাতে প্রাণ গেছে অন্তত ২৩ জনের। সেই সংঘাতের সূত্র ধরেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খপ্পরে পড়েছিলে দেশ। যে জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে দেশের শীর্ষ দুই নেত্রী থেকে শুরু করে প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতাদের। আবারও কী সেই পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ?
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে মূলত ‘অনুগত’ প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলো এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা নিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সমাবেশে যোগ দেন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। সেদিন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিন। আওয়ামী লীগের আন্দোলন দমাতে জামায়াত ও শিবিরের ক্যাডারদের মাঠে নামায় জোট সরকার। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশের সদস্যরাও। জামায়াত নেতা ও জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর উস্কানিতে শুরু হয় সংঘর্ষ। গুলি করে এবং পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় শিউরে ওঠে দেশের মানুষ। ঢাকার সেই সংঘর্ষ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। প্রাণ যায় অন্তত ১১ জনের। ২৮ অক্টোবরের আগে-পরে তিন দিনের সংঘর্ষে মোট ২৩ জনের মৃত্যুর খবর জানা যায় গণমাধ্যমে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুই দলের নাছোড়বান্দা মনোভাব রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে, শর্ত ভুলে সংলাপে এলে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। তবে বিএনপির নেতারা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অটল। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত দেশব্যাপী মহাযাত্রার ঘোষণা দেবে তারা।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, সমাবেশের নামে ঢাকা অবরোধ করার চক্রান্ত করছে বিএনপি। তেমনটি করতে এলে তাদের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ার করেছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ঘিরে সারা দেশের নেতাকর্মীদের রাজধানীতে জড়ো করতে চাইছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। রাজধানী বা আশপাশের এলাকায় ধরপাকড় না বাধা এলে তা প্রতিহত করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের শঙ্কা করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে একটি সংস্থার প্রতিবেদনেও।
তবে সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদের ধারণা, এখনই বড় কোনো সংঘাতের শঙ্কা নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শক্তির ভারসাম্য নেই। যদি তেমন কিছু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতটুকু শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন তা করবে।
বিএনপির অনড় অবস্থান নিয়ে এই বিশ্লেষক বলেন, জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তারা কিছু একটা ঘটাতে চায়। সরকারও সেভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। তাদের আন্দোলনের (বিএনপি) যে প্রক্রিয়া, তা কল্পনাপ্রসূত।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান মুহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, সমাবেশ ডেকে কেউ যদি আইনবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ড ঘটায়, সেক্ষেত্রে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে।