সেপ্টেম্বরের ৮ থেকে ১৩ এ সংঘটিত ছাত্র অভূত্থান বা জেন- জি বিপ্লবে নিহত ৭২ জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং প্রায় দুই হাজারের উপর আহতদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। অন্তর্বতীকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কীর নেতৃত্বে নেপাল এখন বেশ শান্ত। সবাই এখন বিভিন্ন ভবনের পোড়া ছাই পরিষ্কার করতে ব্যস্ত এবং ঘটনার পোস্টমর্টেম করছে। এর মধ্যে বের হয়ে আসছে নানা তথ্য।
কেনো হঠাৎ এই জেন- জি অভূত্থান?
পর্যবেক্ষকগণ জানাচ্ছে, ৬ সেপ্টেম্বর একটা ভিডিয়ো ক্লীপে দেখা যাচ্ছে একজন প্রাদেশিক মন্ত্রীর গাড়ি একটা কিশোরীকে ধাক্কা দিয়ে নির্বিকার চলে যাচ্ছে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে এটাকে একটি সাধারণ ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। এটা ছাত্ররা সহজভাবে নেয়নি। তারা এটাকে সাধারণ নাগরিকের প্রতি তাচ্ছিল্য হিসেবে গ্রহণ করে।
এটা আগুনে ঘি ঢালে। আগুন প্রস্তুত হয়েছিল কয়েক দিন আগে থেকে যখন সরকার পঁচিশটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে করের আওতায় আনার জন্য নিষিদ্ধ করে। এর সাথে যুক্ত ছিল, নেপো- কিডস নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নেপালের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের কিছু সন্তানের বিদেশে বিলাসী জীবন ও প্রাচুর্যের কদর্য প্রদর্শনের প্রচার।
অনেক দিন ধরে নেপালের তরুণরা দেখছে রাজনীতিবিদরা ধনী হচ্ছে কিন্তু বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসে নেপালের দরিদ্র মানুষ কাজের সন্ধানে গিয়ে করুন মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। একেতো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, কোভিড- ১৯ এর কারণে বিদেশের শ্রম বাজার সংকুচিত অন্য দিকে কাজের চাপে প্রবাসে নেপালীদের মৃত্যু সরকার ও রাজনীতির প্রতি মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কাতারে বিশ্বকাপের সময় মাঠ নির্মাণ করতে গিয়ে একজন নেপালীর মৃত্যু এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে নেপালীদের সৈনিক হিসেবে ভাড়া খাটতে যাওয়া সমাজে অসন্তোষ তৈরি করে। এছাড়াও নেপালের অর্ধেক জনসংখ্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে বিদেশে যোগাযোগ রাখে এবং টিকটিক ইত্যাদির মাধ্যমে আয় করার প্রচেষ্টা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা নেপালীদের খুব ক্ষুব্ধ করে। এইসব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ নেপালের তরুণদের ঠেলে দেয় ৮ সেপ্টেম্বর দূর্নীতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ডাক দিতে। তারপরের ঘটনা বিশ্ববাসী মিডিয়ার মাধ্যমে দেখছে।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, নেপালের তরুণদের বিক্ষোভ এক পর্যায়ে মবে পরিণত হয় এবং নেপালের জাতীয় সিম্বলগুলোতে আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সরকার পড়ে যায়, সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে।
২০০৬ সাল থেকে নেপালের রাজনীতিতে বামপন্থীদের অভূদ্যয় ঘটে। ২০০৮ এ রাজতন্ত্রের পতন হয়, নেপাল রিপাবলিক হিসেবে নতুন সংবিধানের আলোকে নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে আসছিল। রাজতন্ত্রের পতনে বামপন্থীদের ভূমিকা প্রশংসিত হয় এবং তারা একটা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। দুনিয়াব্যাপী বামপন্থীদের ভাঙনের মধ্যে তারা ঐক্যের একটা মডেল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা জনসমর্থন পায় এবং নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে। কিন্তু ইলোকট্রোরাল সিস্টেমের কারণে গত সতেরো বছরে বারো বার সরকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু ঘুরেফিরে পুষ্প দহল প্রচন্ড, কে পি শর্মা অলি ও শের বাহাদুর দেউবা প্রধানমন্ত্রী হন। শেষের জন কংগ্রেসের। নেপালের জনগণ কংগ্রেসকে একটা দূর্নীতিগ্স্থ দল মনে করে। তার সাথে মিলে বামপন্থীদের সরকার গঠনকেও জনগণ একটা দুষ্ট দূর্নীতির চক্র হিসেবে দেখেছে।
নেপালের রাজনীতিতে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য, জাতপ্রথা, লিঙ্গ বৈষম্য, পাহাড় ও সমতলের বিরোধ, জাতিগত সংঘাত এবং অস্পৃশ্যতা বড় ভূমিকা রাখে। এরবাইরে আছে, ভারত, চীন, আমেরিকা ও রাশিয়া।
নেপালের আয় আসে পর্যটন থেকে। এই পর্যটনের মাধ্যমে পৃথিবীর ধনী ও দরিদ্র দেশের মানুষ এখানে আসে। নেপাল দরিদ্র কিন্তু তার রাজনীতি ও পর্যটন ধনী। এই পার্থক্য বামপন্থীরা তেমন ঘুচাতে পারেনি। রাজনীতির সুবাদে বামপন্থীরা এখন ক্ষমতা ও সম্পদের মালিক। তাদের কারণে রাজনৈতিক বৈষম্য কিছুটা বিলোপ হলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য তেমন কমেনি। সুযোগ বেড়েছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়েনি। সমাজে বেকারত্বের হার ২০%।
বামপন্থীদের নীতিগত ও জাতীয়তাবাদী অবস্থানের কারণে ভারত ও চীনের বিরোধ নিজেদের রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে। এখন যে দূর্নীতি ও সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য – বামপন্থীদের দাবি ছিল, সেই দাবিগুলোই বামপন্থীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে। আর উত্থাপনের কাজটি সুচারু ভাবে করেছে নেপালের দুটি এনজিও : হামরা নেপাল ও বারবারা ফাউন্ডেশন। এরা এই আন্দোলনেও সম্মুখসারির ভূমিকা পালন করেছে। এদের আড়ালে রাজতন্ত্র ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সামনে এসেছে। এখানেও দূর্নীতি ও বৈষম্যের বিষয়টা নিয়ে এই এনজিওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের সংঘটিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
নেপাল এখন দূর্নীতিমুক্ত হোক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমুক – এটা সবার চাওয়া। এটাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে হবে নাকি এনজিওদের দেখানো পথে যাবে – বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আগামী ফেব্রুয়ারির দিকে যখন নেপালে সংসদ নির্বাচন হবে, তখন।
নেপালের বামপন্থীদের সত্যিকার চ্যালেন্জ এখানেই। তাদের ঐক্য ও দূর্নীতিবিরোধী অবস্থান কতদূর এগোয় তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
বিশ্লেষণঃ শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক



