Sunday,8,December,2024
19 C
Dhaka
Sunday, December 8, 2024
Homeসীমানা পেরিয়েপরিবারতন্ত্রে ডুবল শ্রীলঙ্কা

পরিবারতন্ত্রে ডুবল শ্রীলঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥ ভাই গোতাবায়াকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীলংকার ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে রীতিমতো নায়ক বনে গিয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। কিন্তু নিয়তির পরিহাস নয়, পরিবারতন্ত্রের দুঃখজনক ও নেতিবাচক পরিণতিতে আজ সেই মাহিন্দাই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার ধিকৃত খলনায়ক। ঐতিহাসিক জনরোষে হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীত্ব। গণলাঞ্চনার হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এখন নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের অনেকে আত্মগোপনে আছেন।

মাহিন্দা রাজাপাকসের ভুল শাসন, দুর্নীতি ও অপরিণামদর্শীতার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি চরম খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। দেশটির রিজার্ভ এখন শূণ্যের কোঠায়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের বোঝা। খাদ্য ও জ্বালানি সংকট। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ গাড়ি চলাচল। দোকান কিংবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে পণ্য নাই। এককেজি চালের দাম ৫০০ টাকা। কাগজের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা ও পরীক্ষা দিতে পারছে না। কলকারখানা বন্ধ থাকায় কাজ হারিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। এসব কারণে সৃষ্ট গণঅসন্তোষ থেকে গণবিক্ষোভের মুখে রাজপাকসে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে পালিয়েছেন। কিন্তু তার দলের সরকার কিন্তু এখনো বহাল আছেন। তার ভাই গোতাবায়া নানা কৌশল অবলম্বন করে সরকার টিকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু জনগণের দাবি মাহিন্দ’র পরিবার তথা গোটা সরকারকে সরে যেতে হবে। নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিবারটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল রয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটি। রাজাপাকসে পরিবার বিরোধী জ্বলন্ত এই অগ্নিকু-ের উত্তাপে গোতাবায়াসহ বাকি সদস্যদেরও দেশ ত্যগ করতে হতে পারে।

এই অবস্থার কারণ : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে শ্রীলঙ্কা ভালো অবস্থানে ছিল। দেশটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। দেশটির অর্থনৈতিক আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। এই খাতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনে করোনা। লকডাউনের কারণে এই খাতে আয় বন্ধ হয়ে যায়; যার কারণে সংকটে পড়ে অর্থনীতি। এছাড়া কিছু অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প দেশটিকে ঋণে জর্জরিত করেছে। কোনো যাচাই বাছাই না করে কৃষিতে অর্গানিক পদ্ধতি অবলম্বন করায় উৎপাদনে ধ্বস নামে। দেখা দেয় খাদ্য ঘাটতি। এরই মধ্যে সমান তালে চলেছে দুর্নীতি। সবমিলে সুশাসনের অভাব ও সরকারের দুরদৃষ্টিহীনতার কারণে আজ শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা।

পরিবারটির উত্থান-পতন : দুই দশক ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন রাজাপাকসে পরিবার। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে (১৯৯৪-২০০১)। এরপর একে একে রাজনীতিতে এসেছেন তার অন্য ভাইয়েরা। তার বড় ভাই চামাল এবং চাচাতো বোন নিরুপমাও রাজনীতিতে আছেন। কুমারাতুঙ্গার পর ২০০৫ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহিন্দা। গোতাবায়াকে নিয়োগ দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে। দুই ভাই মিলে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের পরাজিত করেন। এই জয়ের মধ্য দিয়ে রাজাপাকসেরা আরো ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবারের ঘনিষ্ঠদের বসাতে থাকেন দুই ভাই। রাজাপাকসে পরিবারের তৃতীয় প্রজšে§র রাজনীতিবিদ হচ্ছেন মাহিন্দা, মেজ ভাই গোতাবায়া এবং তাদের বড় ভাই চামাল ও ছোট ভাই বাসিল। চতুর্থ প্রজš§ও এরই মধ্যে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। মাহিন্দা ও চামালের সন্তান নামাল, ইয়োসিথা এবং শশীন্দ্র রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। মিস্টার টেন পার্সেন্ট নামে খ্যাত বাসিল নিজে একজন রাজনৈতিক কৌশলবিদÑযিনি মাহিন্দার অধীনে অর্থনৈতিক বিষয়াদি সামলাতেন। সম্প্রতি তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। অপরদিকে চামাল পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। এছাড়া মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি বিমানমন্ত্রী ছিলেন।

দুর্নীতির সুনামি : রাজাপাকসে রাজবংশে পরিবারে দৌরাত্মে চুপসে গেছে গোটা শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক কর্মকা-। এক পরিবারেরই চারভাই সরকারে। এক ভাই প্রেসিডেন্ট, একভাই প্রধানমন্ত্রী (পদত্যাগ করেছেন) ও অন্য দুইভাই কেবিনেট মন্ত্রী। এ সুযোগে পরিবারটি নজিরবিহীন দুর্নীতিতে জাড়িয়ে পড়ে। ফল হিসেবে দেশটি পরিণত হয় ‘তলাবিহীন ঝুড়িতে’। অনেকে মাহিন্দার শাসনামলের দুর্নীতিকে ‘দুর্নীতির সুনামি’ আখ্যা দিয়েছেন। যারা এর সমালোচনা করেন তাদের চরম নীপিড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ কোনো অভিযোগ ছাড়াই সমালোচনাকারীদের গ্রেফতার করা হয়। দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করায় গুম করা হয় কয়েকজন সাংবাদিককে।

টিকতে পারবেন কি গোতাবায়া : মাহিন্দার অবমাননাকর প্রস্থান ঠেকাতে ৭২ বছর বয়সি ছোট ভাই (ভাইয়েদের ভেতর সেজ) প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া কিছুই করেন নি। তিনি এখন নিজের গদি সামলাতেই ব্যস্ত। গণদাবি সত্ত্বেও পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। গণআগুনে পানি ঢালতে নরম সুরে কথা বলছেন, ছাড়ের ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত করতে সম্মত হয়েছেন এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রস্তাবিত ক্রস-পার্টি সরকারের নেতৃত্বে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন। যদিও গোতাবায়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনেকটাই সুতোয় ঝুলছে। অনেকের মতে তিনিও সরে যেতে বাধ্য হবেন- এটি কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সর্বশেষ