উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন রাশিয়া সফরে মস্কো গেছেন। তিনি প্লেনে যান নি, কারণ উওর কোরিয়ার নেতারা ঐতিহ্যগতভাবে প্লেনে চড়েন না। এ নিয়ে কূটনৈতিক মহলে হাসি তামাশা হয়। এবারো হচ্ছে। তার ট্রেনকে অতি বিলাসবহুল থেকে শুরু করে আর কি কি আছে সে সকল বৈভবের প্রচারণা চলছে। কিন্তু একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যখন বিদেশ ভ্রমণ করেন তখন তার সংগে বিশেষ বিমান, বিশেষ গাড়ি, সমুদয় সকল বিশেষ বিষয় নিয়ে কোনো গবেষণাই দেখি না। বরং এক ধরণের আপ্লুত আলোচনা হয়, যে কি কি ছাড়া আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা চলেন না। আসলে একেই বলে বোধ হয় ঈড়ষড়হরধষ ষবমধপু. আসলে আলোচনার বিষয়বস্তুটা এটা নয়। বিষয়টা হলো, মস্কো বৈঠকের ফলাফল জানার আগেই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ঘোষণা করেছে, যদি মস্কো বৈঠকে কোনো সামরিক চুক্তি বা অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপার হয় তাহলে উত্তর কোরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
কিউবা আর উত্তর কোরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা তো আছেই আর কি নিষেধাজ্ঞা হবে? কথায় বলে, নাকের উপর আধহাত পানিও যা তিন হাত পানিও তাই। দু’দিন আগে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে নয়াদিল্লিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জি-২০ শীর্ষ বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকের সঙ্গেই আন্তরিক ব্যবহার করে গেলেন। তাই নিয়ে কূটনৈতিক আর রাজনৈতিক মহলে কত কথা চালাচালি চলছে। অথচ ভিয়েতনামে নেমেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সুর পালটে গেল। তিনি ভারতের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের বৈকল্য দেখতে পেলেন। মনে হচ্ছে কোথাও তাল কেটেছে। সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনা উল্লেখ করে একটু তাত্বিক আর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলা যাক।
আসলে ইতিহাস এবং তত্ব সিদ্ধান্তমূলকভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, যে যেভাবেই বলুক না কেন সা¤্রাজ্যবাদের জোয়ালের অধীনে কোনো ধরণের বৈষম্য, অন্যায্যতা এবং শ্রেণীভিত্তিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। সা¤্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদ থেকে আলাদা করা যায় না এবং এটা এর উৎপাদন প্রক্রিয়ার স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। এই যুগে সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ভিন্ন পুঁজিবাদ বাঁচতে পারে না, কারণ এটা এমন এক ব্যবস্থা যার প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণ প্রয়োজন, এটাকে সকল সীমান্ত ভাঙ্গতে হয়, সকল সীমা অতিক্রম করতে হয়, মুনাফা বৃদ্ধি ছাড়া এটা ভেঙে পড়ে।
পুঁজিবাদ এমনই এক ব্যবস্থা যা ন্যায্যতাকে ভিত্তি করে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি করতে পারে না। এটা অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দিতামূলক ব্যবস্থা যা এর অস্তিত্বের অংশ বিশেষ, যেখানে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের উপর প্রাধান্য করবে যাতে প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা তৈরি হয়। গঠনগতভাবেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কখনো সমগ্র বিশ্বে সমান উন্নয়নের অনুমতি বা সুযোগ দেবে না। তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই বিশ্বের সকল উন্নয়ন ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাবে, যাতে যারা শক্তিশালী তারা দুর্বলকে শোষণ করে নিজে শক্তিশালী থাকতে পারে।
সা¤্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের এবং তাদের মতাদর্শিক বুদ্ধিজীবি, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং সাংবাদিক বাহিনীর বিস্তৃত ব্যাখ্যা এবং বক্তব্য সত্বেও এটা অভ্রান্তভাবে বলা যায় যে, পুঁজিবাদ সাম্য তৈরি করতে পারে না এবং গোটা বিশ্বে সমন্বিত উন্নয়নকে সমর্থন করে না। এটা একটা প্রমানিত সত্য যে, পুঁজিবাদের অধীনে থেকে তথাকথিত সঠিক অর্থনীতিক নীতি ব্যবহার করে আমরা সবাই দারিদ্র, প্রান্তিকতা, সন্ত্রাস এবং অগণিত অসুস্থ ব্যবস্থা যা প্রতিনিয়ত একটি অনুন্নত অর্থনীতি তৈরি করে তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। অন্যদিকে, পুঁজিবাদের তার প্রান্তিক পরিসরে প্রয়োজন অনুন্নয়ন। আর সেই অনুন্নয়ন আর বৈষম্য তৈরির জন্য প্রয়োজন সা¤্রাজ্যবাদী নয়া-উদারনীতিক নীতি।
এই অনস্বীকার্য বাস্তবতার নিরিখে, বহুবিধ এই অন্যায় যা পুঁজিবাদী শোষণ থেকে উদ্ভূত তার বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রামই রণনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ হতে পারে না, যদি না তা সুনির্দিষ্টভাবে একটা সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। অর্থনৈতিক নির্ভরতা, অনুন্নয়ন দূর করার উদ্যোগ নেয়া, অথবা সামাজিক প্রয়োজনে সম্পদকে পূনর্বন্টন করার পদক্ষেপ, সবই শেষ বিশ্লেষণে সা¤্রাজ্যবাদের বাধার সম্মুখীন হবে। এই সত্যতার অগণিত উদাহরণ আমাদের হাতে আছে।
সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি জবরদস্তি এবং সম্মতিতে শাসন করে, তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য। একটার পর একটা রণনীতি প্রয়োগ করে যা তাদের কাছে সুবিধাজনক বা সম্ভাব্য মনে হয়। যখন প্রান্তিক কোনো দেশের সম্ভ্রান্তদের ( ঊষরঃ ) সংগে যোগসাজশ সম্ভব হয়, সা¤্রাজ্যবাদীরা সেই রাস্তা ধরে. এইভাবে বিভিন্ন দেশের জাতীয় পুঁজিবাদী শক্তিকে তাদের মিত্র তৈরি করে এবং সা¤্রাজ্যবাদী শোষণের দ্বিতীয় শ্রেণীর সুবিধাভোগী তৈরি করে। যখন জাতীয় পুঁজিবাদীদের দলে টানতে না পারে তখন তারা রাস্তা পাল্টায়, তখন কোনো রাস্তাই বন্ধ থাকে না, অর্থনৈতিক নাশকতা থেকে সরাসরি সামরিক অভিযান সবই ব্যবহৃত হয়।
আসলে পুঁজিবাদ আর তার সা¤্রাজ্যবাদী রূপ (বর্তমান নয়া-উদারনীতিবাদ) কোনো অবস্থাতেই পাল্টায় না। পশ্চিমা গণতন্ত্রের নামে, হিউম্যান রাইটস এর নামে, প্রেস আর বাক স্বাধীনতার নামে গত এক শতাব্দী সা¤্রাজ্যবাদ যা করেছে, সেটা মানব জাতি ভুলতে বসেছে। এটাই হলো সবচাইতে ভয়ের ব্যাপার। গোটা বিশ্বে যে অশনিসংকেত চলছে, তা বুঝে চলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিজেদের সংকট নিজেরা না বুঝলে আখেরে বিপদ সমাসন্ন।
উন্নত পুঁজিবাদী দেশ যারা গত শতাব্দী ধরে প্রত্যক্ষ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে পৃথিবী শোষণ করেছে, নিজেরা উন্নত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের রূপ পাল্টেছে, অন্তর্বস্তু পাল্টেনি, যাকে বলা হয়েছে নয়া উপনিবেশবাদ। তা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যাকে তারাই বলেছে নয়-উদারনীতিবাদ। এর শেষ পরিণতি কি? হয় গোটা বিশ্বের মানুষকে বিকল্প পথ বের করতে হবে নতুবা মানব সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। আশার কথা হলো মানব সভ্যতা এর আগেও অনেক ভয়াবহ দূর্যোগ পেরিয়েছে, এখনো পেরুবে। প্রয়োজন বিপদটা বোঝা আর তার মোকাবিলার রাস্তা তৈরি করা। এটা বর্তমান প্রজন্মের হাতেই আছে।
লেখকঃ পলিটব্যুরোর সদস্য , বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।