।। সুদীপ্ত অর্ক দাস ।।
২০ শতকের দুই দুইটি সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের উত্থান, মহামন্দা, স্নায়ুযুদ্ধ আমাদের চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে পুঁজিবাদ আর তার প্রগতিশীলতার ধারায় নেই। আর এই ২১ শতকে এসে আমরা দেখি তা বিশ্বজুড়ে সমাজের অগ্রযাত্রার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২য় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রবৃদ্ধির দিন শেষ হয়েছে বহু আগেই, সিলিকন ভ্যালি আর ওয়ালস্ট্রিট এর উন্মাদনার হালেও আর পানি নেই। জ্বালানি সংকট আর পরিবেশ বিপর্যয় মাথায় নিয়ে শাসক শ্রেণীর সামনে এখন যুদ্ধ ছাড়া আর বাজার তৈরির কোন রাস্তা খোলা নেই। অবস্থা এতোই খারাপ যে গত শতাব্দীর শেষ ভাগের পরাক্রমশালী উত্তরাধুনিকদের কণ্ঠেও আজকাল হতাশাবাদ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না।
সংকটের কথা মনে করিয়ে শুরু করাটা জরুরি, কারণ মানুষ ও তার সমাজ চারিত্রিকভাবে রক্ষণশীল। তার আচার, ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধ, দর্শন, সবকিছুতেই সে পরিবর্তনকে বিকর্ষণ করে। কেউই রক্ষণশীলতার বাঁধন থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। আবার সমাজের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য রক্ষণশীলতা অপরিহার্যও। সেজন্যই একে মনিষীরা ‘সংস্কৃতি’ নামক একটি সহনীয় নামে ডেকে থাকেন। মানুষ ও তার সমাজ প্রবল সংকটে না পড়লে এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনা, তা সে ধূমপান হোক কিংবা সমাজ ব্যবস্থা।
সভ্যতার অগ্রগতি নির্ধারিত হয় শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে। কিন্তু তার ফল সমাজ উপভোগ করতে পারে তখনই যখন তা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজে স্থান করে নেয়। আগুন, অস্ত্র, লাঙ্গল, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পুঁজিবাদ, স্বয়ংক্রিয়যন্ত্র, বিদ্যুৎ, অ্যান্টিবায়োটিক, কম্পিউটার সবকিছুই সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেই সমহিমায় ভাস্বর। নচেৎ তারা কতগুলো বিমূর্ত ধারণামাত্র।
কিন্তু অপরদিকে, সংস্কৃতির সহজাত প্রবৃত্তিই হলো পরিবর্তনকে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা প্রয়োগ করা। অর্থাৎ, কোন অগ্রগতি যদি সংস্কৃতিতে স্থান না পায় তবে তার যেমন কোন সুফল নেই, তেমনি আবার সংস্কৃতি নিজেই অগ্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দ্বন্দ্বের একটি আদর্শ উদাহরণ আমরা আলোচনার শুরুতেই পেয়ে গেলাম।
এবার আসা যাক বিজ্ঞানে। বিজ্ঞানী ও তাদের বিজ্ঞানকে অনেকেই সমাজের তথাকথিত দৈনন্দিন কার্যকলাপ থেকে অনেক উঁচুস্থানে বসান। বিশেষ করে তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা গত শতকে রীতিমত পৌরাণিক চরিত্র ধারণ করেছেন। এই পালে বাতাস দিয়েছে জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, সিনেমা ও কার্টুনগুলো। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে বিজ্ঞানীরা সমাজেরই অংশ। সমাজের প্রচলিত সংস্কৃতির বেশ বড় প্রভাব আছে তাদের ওপর। বর্তমানের সমাজব্যবস্থার পঁচনের ছাপ অন্য সবকিছুর মতো বিজ্ঞানের ওপরও প্রকট।
এ ব্যাপারে আরও কিছুটা গভীরে যেতে হলে আমাদের পুঁজিবাদ ও আধুনিক বিজ্ঞানকে পাশাপাশি রেখে তাদের ঐতিহাসিক গতিপথ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পুঁজিবাদের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক ওতপ্রোত। ইউরোপের রেনেসাঁয় তারা হাত ধরাধরি করেই ছিল সমাজের অগ্রসর অংশ হিসেবে। বিজ্ঞানীরা একের পর এক কুঠারাঘাত করে যাচ্ছিলেন প্রচলিত সংস্কৃতির ওপর। পরাক্রমশালী সামন্ত ও ধর্মগুরুরা তাদের সামনে ছিল অসহায়। পুঁজির বিনিয়োগ ও বিজ্ঞানের আবিষ্কার জন্ম দিয়েছিল শিল্প বিপ্লবের। তারা কবর দিয়েছিল মধ্যযুগের, জন্ম দিয়েছিল আধুনিকতার।
তারপর সময়ের সাথে সাথে দেখা যেতে লাগল পুঁজিবাদের সম্পদের মেরুকরণের প্রবণতা। তা বিজ্ঞানের মধ্যেও দেখা গেল। বিজ্ঞান বাড়ির পিছনের উঠোন থেকে চলে গেল অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, হার্ভার্ড এর মত পুঁজি নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি মালিকানাধীন বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সাধারণের নাগালের বাইরে। শুরু হলো পেটেন্ট এর প্রতিযোগিতা। বিজ্ঞান পরিণত হলো একটি লাভজনক ব্যবসায়। এই আগুনে ঘি ঢাললেন আলফ্রেড নোবেল। সেই নোবেল প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে কোন আবিষ্কারকে সমাজে প্রচারের আর সময় থাকলোনা। সংস্কৃতির বিকাশ হলোনা। বিজ্ঞান চলে গেল সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে। আজ মানুষ যেমন জানে না মুদ্রাবাজারে কি হয় তেমনি জানে না ২৭ কিলোমিটার পরিধির লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার এ কি হয়। ফলে যে বিজ্ঞান মানুষকে ধর্মগুরুদের প্রশ্ন করা শিখিয়েছিল, সেই বিজ্ঞান নিজেই আজ ‘বিশ্বাসে’ পর্যবসিত হয়েছে। সেজন্যই বিগব্যাঙ হয়ে যাচ্ছে সৃষ্টির ক্ষণ, হিগস বোসন হয়ে যাচ্ছে ঈশ্বর–কণা, ডার্ক ম্যাটার হয়ে যাচ্ছে পৌরাণিক জন্তুদের উপস্থিতির প্রমাণ, ১৪ মাত্রার হাইপারস্পেস হয়ে যাচ্ছে সাত আসমান সাত জমিন। এমনকি ধর্মের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা বিবর্তনবাদের কথাও আজকাল ধর্ম বই এর আনাচে কানাচে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। পণ্ডিতেরা সমালোচনায় বলেন, মার্ক্সবাদ নাকি সমাজের প্রতিটি উপাদানকে অর্থনীতিতে পর্যবসিত করে। ধর্মের এই বৈজ্ঞানিকীকরণ অথবা বিজ্ঞানের ধর্মীয়করণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কিভাবে উৎপাদন সম্পর্ক আর শাসক শ্রেণীর সংস্কৃতি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
তবে সব কিছুই নষ্টদের অধিকারে এখনো যায়নি। পুরো বিশ্বজুড়েই বিজ্ঞানীরা আবার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। নবায়নযোগ্য শক্তি, জলবায়ু, অর্গানিক খাদ্য, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার, প্রভৃতি ইস্যুতে তাদের আন্দোলন ও প্রচার বড় পুঁজির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে যাচ্ছে। তবে সেসব আন্দোলনকে এনজিও, ভাড়াখাটা বুদ্ধিজীবি–বিজ্ঞানী, এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের দ্বারা দখলের পাঁয়তারাও প্রবল। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে দরকার ইতিহাসের নির্মোহ বস্তুবাদী বিশ্লেষণের ক্ষমতা এবং শক্ত দার্শনিক ভিত্তি।
দর্শনের কথা উঠলেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে মুখ বাঁকা করার প্রবণতা এটাকে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। দর্শন বলতে অনেক বিজ্ঞানীই এখন বোঝেন ভাববাদকে। কিন্তু বস্তুবাদ যে ভাববাদকে পরাজিত করে দর্শনের আধুনিকতার সূচনা করেছিল, এবং বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি যে সেই বস্তুবাদেরই অংশ, তা তাদের সিলেবাসের বাইরেই থেকে যায়। এর ফল কখনোই ভালো হয়না। কারণ এই দার্শনিক দৈন্যের শূন্য স্থানে জেঁকে বসে শাসক শ্রেণীর নষ্ট সংস্কৃতি। প্রমাণ স্বরূপ চারপাশে আজ স্বার্থপর, প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্ম–ব্যবসায়ী, প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক, মেরুদণ্ডহীন বিজ্ঞানীদের অহরহ দেখা যায়। ছাত্রজীবন যার যত সাফল্যময় তার মধ্যে এসকল প্রবণতা তত বেশি। যা নিঃসন্দেহে এক অশনি সংকেত। এর থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের ব্যাপক চর্চা। আর এখানেই চলে আসে দ্বন্দ্বের স্বরূপ উপলব্ধির প্রশ্ন। এই মহাবিশ্ব ও তার প্রতিটি উপাদান দাঁড়িয়েই আছে এক দ্বান্দ্বিক গতিশীল সাম্যাবস্থায়। দ্বন্দ্ব ছাড়া বস্তুকে উপলব্ধিই কষ্টকর আর দর্শন তো সুদূর পরাহত।
এই আলোচনায় ডায়ালেক্টিকস ও দ্বন্দ্বকে ভিন্ন বলে ধরা হবে। দ্বন্দ্ব হলো বৈপরীত্য বা Contradiction. অপরদিকে, ডায়ালেক্টিকস হলো সেই দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা। ডায়ালেক্টিকসকে প্রথম সামনে তুলে আনেন হেগেল। অনেকের মনেই এই ভুল ধারণা বিদ্যমান যে, মার্ক্স তার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হেগেলের কাছে থেকে পেয়েছেন। হেগেল তার ডায়ালেক্টিকস ব্যাখ্যা করেছেন মনুষ্য চেতনাকে বস্তুজগৎ থেকে আলাদা বিচার করে আর মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাদের ডায়ালেক্টিকস ব্যাখ্যা করেছেন মননকে বস্তুজগতের সাথে রেখেই। সেজন্যই প্রথমজন ভাববাদী এবং দ্বিতীয়রা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। এর বিশদ বিশ্লেষণ আলোচ্য বিষয়বস্তুর বাইরে হওয়ায় এই আলাপের এখানেই ইতি টানা যেতে পারে।
ডায়ালেক্টিকস আমাদের বলে সবকিছু নিয়ত গতিশীল, তা সে অণু–পরমাণুই হোক কিংবা গ্রহ–নক্ষত্র। আমরা আমাদের সীমিত খালি চোখে তা সবসময় অনুধাবন করিনা। এবং এই গতিশীলতার মধ্যে বৈপরীত্য কাজ করে। আর এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই সবকিছুর বিকাশ হয়। সেজন্যই কোন কিছু বিকাশের কিংবা পরিবর্তনের পথ কখনো মসৃণ হয়না। ধীরে ধীরে জড়ো হওয়া পরিবর্তন হঠাৎ করে বড় পরিবর্তনের সূচনা করে।
ফর্মাল লজিক যে ধ্রুব সত্যের খোঁজ করে, ডায়ালেক্টিকস তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাটে। এঙ্গেলস তার অ্যান্টি ডুরিং এবং দি ডায়ালেক্টিকস অফ নেচার প্রবন্ধে ডায়ালেক্টিকস এর তিনটি দিক তুলে ধরেছেন।
১। পরিমাণগত থেকে গুণগত পরিবর্তন (quantity to quality)
২। বিপরীতের আন্তর্ব্যাপন (interpenetration of opposites)
৩। অস্বীকারের অস্বীকার (negation of negation)
আজকের আলোচনায় এই বিষয়গুলোর ওপরই সংক্ষেপে আলোকপাতের চেষ্টা করব।
পরিমাণগত থেকে গুণগত পরিবর্তন এবং তার মধ্যকার অনিশ্চয়তা আমরা পরমাণুর অভ্যন্তর থেকে বিশাল মহাকাশ –সবখানেই দেখতে পাই। গ্রিক দার্শনিকেরা এ নিয়ে বরাবরই মজা করত ‘টাক মাথা’র কথা বলে। মাথা থেকে একটি চুল পড়লে কি সেই মাথা টাক?দুটি চুল?কিংবা তিনটি?তাহলে ঠিক কতটা চুল কমলে মাথা টাক হবে?এভাবেই আমরা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ি যখন ছোট ছোট পরিবর্তন, যা এককভাবে কোন গুণগত পরিবর্তনই সাধন করতে পারেনা, কিন্তু একটা অনিশ্চিত পরিমানে তারা ঠিক সেটাই করে দেখায়।
“Butterfly effect”এর ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা আছে। এটা বলে পৃথিবীর একপ্রান্তের একটা প্রজাপতির পাখার ঝাপটা অপরপ্রান্তে হারিকেন তৈরি করতে পারে। এটা আসলে পরিমাণগত পরিবর্তনগুলো যোগ হয়ে যখন কোন একটা সময়ে হঠাৎ করে গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি হয়, তারই জনপ্রিয় বহিঃপ্রকাশ মাত্র। পদার্থের গুণগত অবস্থা পরিবর্তনকে বাঁধা দান করে আর পরিমাণগত পরিবর্তন তার গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর নিয়ত চেষ্টা করে। এই দ্বন্দ্বে যে মুহূর্তে গুণগত অবস্থা পরাজিত হয় সেই মুহূর্তে পদার্থের বিশাল এক গুণগত পরিবর্তন হয়।
যদিও উদাহরণগুলো আপাতদৃষ্টিতে হালকা তবুও এগুলো প্রকৃতির কাজের ধরনের গভীর সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এ নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে এখন বিস্তর। গুণগত পরিবর্তনের এই মুহূর্তটিকে এখন বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় “Edge of Chaos”.ডেনিশ বিজ্ঞানী পার বাক ও অন্যান্যদের “Self-organizing criticality” গবেষণা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে তারা বালির স্তূপের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন কিভাবে একটিমাত্র বালির কণা বিশেষ মুহূর্তে পুরো বালির স্তূপের গঠনের গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
এই পরীক্ষায় তারা একটি সমতল স্থানে একটি একটি করে বালিকণা ফেলতে থাকেন এবং বালিকণাগুলো নিজেরা একটা পিরামিড আকৃতির ঢিবি তৈরি করতে থাকে। একে তারা বললেন “Self-organizing”. কিন্তু একটা সময়ের পর একটিমাত্র বালিকণা পুরো ব্যবস্থাটাকে ভারসাম্যহীন করে একটা বিশাল যা অনেকগুলো বালিকনাকে একদম গোঁড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলে। ঢিবির আকৃতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
আপাতদৃষ্টিতে মূল্যহীন এই পরীক্ষা থেকে ঐ গবেষকরা গাণিতিক সমীকরণ বের করেছেন, যা ব্যবহার করে ভূমিকম্প, বিবর্তন, স্টক মার্কেটের ধ্বস, এমনকি যুদ্ধের আগাম সতর্কতা দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারন উপরের সবগুলো ঘটনাই পরিমাণগত থেকে গুণগত পরিবর্তনের উদাহরণ।
আজকের এই বিজ্ঞানীরা হেগেলকে চেনেন কিনা জানি না কিন্তু হেগেল সেই মধ্যযুগে বসে এই কথা বলেছিলেন এবং উদাহরণ হিসেবে বলেছিলেন পানির বাষ্পীভবনের কথা। তাপমাত্রা বাড়লে অণুগুলোর ছোটাছুটি বেড়ে যায় এবং তা ঠিক ১০০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এই পরিমাণে হয় যে নিজেদের মধ্যে আকর্ষণ আর তাদের ধরে রাখতে পারেনা। ফলে তারা বাষ্পে পরিণত হয়।
যুগে যুগে সমাজের পরিবর্তনও এভাবেই হয়ে এসেছে। নানা ধরণের ছোট ছোট পরিবর্তন যুক্ত হয়ে একসময় বড় কোন পরিবর্তন হয়েছে। এখান থেকে শিক্ষণীয় যে ব্যাপারটি আছে তা হলো যে কোন ব্যবস্থা (তা সে বালির স্তুপ, পানি, কিংবা সমাজ যাই হোক না কেন) তার গুণগত পরিবর্তন সবসময় খুব কম সময়ের মধ্যেই হয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণগত পরিবর্তন জড়ো হতে সময় লাগে। “Smooth transition” বলে প্রকৃতিতে কিছু নেই। সবখানেই আছে থেকে থেকে হঠাৎ পরিবর্তন। এমতাবস্থায় সমাজের বিবর্তন নিরামিষ সরলরেখায় হবে তা ভাবার কোন সুযোগ নেই।
আলোচনার এই পর্যায়ে ভাববাদের খণ্ডনটা জরুরি। “Formal Logic” অনুসারে, একটা পুরো বস্তু বা ব্যবস্থা তার গঠনকারী অংশগুলোর যোগফল মাত্র। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই ধারণার মধ্যে বিশাল গলদ আছে। একটা মুরগিকে কেটে টুকরো টুকরো করে সাজিয়ে রাখলে তার সব গঠনকারী অংশই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু তখন আর তা ‘মুরগি’ থাকে না। ভাববাদীরা একেই আত্মা, জীবন ইত্যাদি দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু আসলে প্রকৃতির প্রত্যেকটি বস্তুর মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন, একটি গাড়ির সব যন্ত্রাংশকে একসাথে স্তূপ করে রাখলেই কিন্তু সেটাকে ‘গাড়ি’ বলা চলেনা। কারণ গাড়ির সবচেয়ে প্রাথমিক গুণাবলীর কোনটিই তার মধ্যে বিদ্যমান নেই। এমতাবস্থায় ভাববাদ অনুসারে আমাদের ধারণা করে নিতে হয় যে গাড়িরও আত্মা আছে!
এখানেই আমরা বুঝতে পারি প্রাণ, আত্মা, বা মনের ভাববাদী ধারণা আসলে কত ঠুনকো। আমাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য নিউরনের সমষ্টি। একটি নিউরনের নিজের চিন্তা করার ক্ষমতা বা ‘মন’ নেই। কিন্তু অসংখ্য নিউরন যখন একসাথে একটি বিশেষ উপায়ে সঙ্গবদ্ধ হয় তখন এই সমষ্টির একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে যা তাকে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য দান করে। এখানে কোন ‘বাহ্যিক’ অতিপ্রাকৃতিক কারসাজি নেই। মানুষের জন্য এই সহজ সত্যটা অনুধাবন করা আধুনিক যুগের আগে সম্ভব ছিলনা। কারণ এর আগে মানুষ নিজে এমন কোন স্বয়ংক্রিয় জটিল যন্ত্র উদ্ভাবন করেনি যে, সে এই জটিলতা থেকে সৃষ্ট নতুন বৈশিষ্ট্যাবলীর ব্যাপারে চিন্তা করতে পারবে।
হেরাক্লিটাস সেই ২০০০ বছর আগেই বুঝেছিলেন যে, প্রকৃতির যেদিকেই তাকানো হোক না কেন বিপরীতমুখী প্রবণতার একটা চলমান সাম্যাবস্থা দেখা যায়। দর্শনের যে দ্বান্দ্বিকতা তা শুধুমাত্র খাতা–কলমে বা চিন্তায় না, প্রকৃতির সর্বত্র বিদ্যমান। হেরাক্লিটাসের সেদিনকার ধারণা আজ অসংখ্য উদাহরণ দ্বারা প্রমাণিত। সেই ধনাত্মক প্রোটন আর ঋণাত্মক ইলেকট্রন থেকে শুরু করে ঘুরতে থাকা পৃথিবীর বিকেন্দ্রিক (centrifugal) বলের বিপরীতে মাধ্যাকর্ষণ বল – সবই এর মধ্যে পড়ে। এই বিপরীত প্রবণতাগুলো একে অপরকে সাম্যাবস্থায় রাখে। এই সাম্যাবস্থার পরিবর্তন ঘটলেই গুণগত পরিবর্তন হয়।
সমাজ, জলবায়ু, প্রকৃতি – সবকিছুই সাম্যাবস্থায় আছে। এই সাম্যাবস্থার কোনরূপ পরিবর্তন ঘটলেই এর গুণগত পরিবর্তন হতে বাধ্য। এবং তা ভালো কিংবা খারাপ উভয় দিকেই হতে পারে। ভালো হলে তার বিকাশ হবে, খারাপ হলে হবে ধ্বংস। এখানেও দ্বান্দ্বিকতা আছে। আমাদের সভ্যতার কাছে যা ধ্বংস অন্য প্রজাতির কাছে তা বিকাশের সুযোগও হতে পারে। যেমন হয়েছিল ডাইনোসরের বেলায়।
একটা বীজ যখন অংকুরিত হয় তখন মনে হতে পারে যে বীজের ধ্বংস হল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বীজ বেঁচে রইল গাছ হয়ে যা ভবিষ্যতে আরও বীজ উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়। অর্থাৎ এখানে গাছ হয়ে বীজ নিজেকে অস্বীকার(negate) করেনি বরং নিজের অস্বীকার(negate) হওয়াকে অস্বীকার করেছে। কারণ শুধু বীজ হয়ে থাকলে তার সামনে পঁচন বিনা আর কোন পথ খোলা থাকেনা। তেমনি প্রকৃতির প্রত্যেকটি জটিল ব্যবস্থা(complex system) যা অনেকগুলো দ্বান্দ্বিক সাম্যাবস্থার মধ্যে বিরাজ করে, তাকে নিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ পরিবর্তন কখনোই সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটায় না বরং তার বিলুপ্তিকে অস্বীকার(negate) করে।
এজন্যই সমাজের জন্য প্রগতিশীলতা এতো প্রয়োজনীয় কারণ এর অভাবে সমাজের গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ থাকেনা। আর স্থবির সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।
জটিল ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে এক ধরণের চক্রাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, বীজ–গাছ–বীজ। এই মতে চিন্তা করে অনেকে বলতে পারেন যে বীজের যদি নিজের পঁচন ঠেকানোর উপায় জানা থাকে তাহলে তার কি আর গাছ হওয়ার এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার দরকার আছে?উত্তর হল আছে। কারণ শুধুমাত্র চক্রাকারে ঘুরলে অস্বীকারের অস্বীকার করা সম্ভব হয়না। প্রতিটি কৃষকই জানে যে, পরের প্রজন্মের বীজের গাছ আগের প্রজন্মের থেকে কিছুটা ভিন্ন হয়। আর ভিন্নতার সদ্ব্যবহার করেই নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়। এটাই বিবর্তন প্রকৃতিতে যা হয় ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ আর কৃষকের ক্ষেতে হয় ‘কৃত্রিমনির্বাচন’এর মাধ্যমে। এভাবেই গাছ আগামীর উদ্ভূত প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ায়। বীজ থেকে গাছ হওয়া অল্প সময়ের জন্য বীজের ধ্বংসকে ঠেকায় কিন্তু বিবর্তন বিনা সুদূর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার তার আর কোন উপায় নেই।
পরিবর্তনের এই দার্শনিক ধারণা অনুধাবন খুবই জরুরী কারণ তা না হলে অনেকেই পরিবর্তন আর নতুনের আগমনের আসল গুরুত্বকে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে থাকেন। যেমন অনেকেই মার্ক্সের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, তার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নাকি প্রাচীন গ্রীক দর্শনে প্রচলিত Thesis-Antithesis-Synthesis কার্যপদ্ধতির মত! যেখানে একদল একটি প্রস্তাব(thesis) উপস্থাপন করে, আরেকদল তার বিরোধী তত্ত্ব (antithesis) প্রদান করে এবং দুইএর বিতর্কের ফলে নতুন তত্ত্ব (synthesis) জন্ম নেয়। কিন্তু এই কার্যপদ্ধতির নানা দূর্বলতার জন্য দার্শনিকগণ পরবর্তীতে একে ত্যাগ করেন। এখন নিন্দুকদের দাবি মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মানলে নাকি সেই প্রাচীন তত্ত্বকেও স্বীকার করতে হবে নতুবা কোনটাকেই নয়!
এই সমালোচনার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিলেন প্লেখানভ। তিনি উদাহরণ হিসেবে এনেছিলেন আলকেমিকে। আলকেমিস্টরা কতগুলো সহজসাধ্য অ–প্রচলিত রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পর্কে জানত যেগুলোকে তারা বলত ট্রান্সমিউটেশন (transmutation) আর তারা বিশ্বাস করতো এর প্রয়োগের ফলে তারা একদিন মাটি থেকে সোনা তৈরি করে বড়োলোক হবে। আর সেই বিক্রিয়ার আদর্শ প্রভাবক (catalyst) এর তারা নাম দিয়েছিল Philosopher’s stone. তারা বেশ কয়েক শতাব্দী এই পরশ পাথরের খোঁজ করতে গিয়ে বহু মৌলিক পদার্থ (element) আবিষ্কার করে ফেলল এবং এক সময় মেনে নিল যে একটি মৌলিক পদার্থকে আরেকটি মৌলিক পদার্থে পরিণত করা যায়না, খালি নতুন নতুন যৌগ তৈরি করা যায়। এবং এখান থেকেই শুরু হয় আধুনিক রসায়নের।
কিন্তু আবার উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আণবিক পদার্থবিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিলেন যে, এক মৌলকে আরেক মৌলতে রূপান্তর আসলেই করা যায়। তারা দেখলেন তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণ করে ইউরেনিয়াম এক সময় সীসাতে পরিণত হয়। তারা এও বের করলেন যে, যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করে যদি কোন মৌলের নিউক্লিয়াসকে ভাঙা বা জোড়া লাগানো (fission or fusion reaction) যায় তাহলে যেকোনো মৌল থেকে অন্য মৌল তৈরি করা যায়। এমনকি সোনা রুপা প্লাটিনামের মত মূল্যবান মৌলও! যদিও যা খরচ হবে তাতে লাভ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।
তার মানে সেই প্রাচীন আলকেমিস্টদের স্বপ্ন একেবারে অলিক ছিলনা। কিন্তু এখন কেউ যদি বলে আণবিক পদার্থবিজ্ঞান আর আলকেমি মূলত একই জিনিস, এবং একটাকে ঠিক মানলে অন্যটাকেও ঠিক মানতে হবে নতুবা কোনটাকেই নয়, অথবা রসায়ন যেহেতু আলকেমিকে ভুল প্রমাণ করেছে সেহেতু আণবিক পদার্থবিদ্যার কোন স্থান নেই; যে কেউ বলবে সেটা হাস্যকর দাবি।
এভাবেই সবকিছুর বিবর্তন হয়। দার্জিলিং এ টয় ট্রেনে পাহাড় চড়ার মত। ঘুরে ঘুরে একই দিকে আসা হয় কিন্তু ভিন্ন উচ্চতায়। আলকেমিস্টদের ধারণার সাথে আণবিক পদার্থবিজ্ঞান মিলে গেলেও তা জ্ঞানের সম্পূর্ণ নতুন এক পর্যায়ে উঠে এসেছে যা আলকেমি চর্চার মাধ্যমে লক্ষ বছরেও সম্ভব ছিলনা। এভাবেই আলকেমি নিজের স্বপ্নের অস্তিত্ব টিকিয়েছিল রসায়নে বিলীন হয়ে যা আসলে ঐ বীজের মতই অস্বীকারের অস্বীকার। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদও দার্শনিক দিক থেকে প্রাচীন গ্রীক পদ্ধতির থেকে বহু উপরে আসীন। একটার অস্বীকারই পরেরটার আগমনের পথকে খুলে দেয় এবং তা প্রথমটাকে বাঁচিয়ে রাখে সেই অস্বীকার হওয়াকে অস্বীকার করেই।
সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। মার্ক্সের শ্রেণীহীন সমাজের সাথে প্রাচীনকালের শ্রেণীহীন সমাজের মিল খুঁজতে মার্ক্সবাদী ও অমার্ক্সবাদী উভয়েই দারুণ উৎসাহী। একদল সেই তুলনাকে ব্যবহার করে মার্ক্সবাদের পক্ষে যুক্তি দিতে আরেকদল ব্যবহার করে মার্ক্সবাদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করতে। উভয়ই হাস্যকর ছেলেমানুষি। সেই প্রাচীন শ্রেণীহীন সমাজ লক্ষ বছরেও সভ্যতাকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করাতে পারত না। আর মার্ক্সের শ্রেণীহীন সমাজ তার থেকে বহুগুণ উন্নত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। কিন্তু এই শ্রেণীহীনতা নিজে এক সময় বিলীন হয়েই সভ্যতার অগ্রগতির রাস্তায় তার অস্বীকারকে অস্বীকার করেছে।
ঠিক এই নিয়মেই আজকে আমরা দেখতে পাই যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা সভ্যতাকে আর সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারছেনা, বরং তা সমাজের পঁচন ধরাচ্ছে। এখন যদি সে নিজেকে অস্বীকার না করে তার ভবিষ্যতে অস্বীকারের অস্বীকার হবেনা। সভ্যতার ধ্বংস হবে অনিবার্য। কিন্তু আজকে যদি শ্রেণীর পতন ঘটে তবে তার গুণগুলোকে মহিমান্বিত করে এবং দোষগুলোকে ঝেড়ে ফেলে আবারো নতুন রূপে নতুন দার্শনিক উচ্চতায় পরবর্তী যুগে হয়ত ফিরে আসার সুযোগ পাবে, যখন শ্রেণীহীন সমাজ তার আধুনিকতা আর প্রগতিশীলতা হারিয়ে স্থবির হয়ে যাবে। তখন দার্শনিকেরা পুরনো শ্রেণী আর নতুন শ্রেণীর মধ্যকার তুলনা করে হতবাক হবে ঠিক আজকের আলকেমি আর আণবিক পদার্থবিজ্ঞানের মত! আর সেযুগের মার্ক্সবাদীরা হয়ত প্রতিক্রিয়াশীলদের মত তা খণ্ডনের চেষ্টাও করবে শ্রেণীর দোহাই দিয়েই!
এই যে সভ্যতার হাল একেকবার একেকজনের হাতে যাওয়া – এও প্রকৃতপক্ষে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদেরই স্পষ্ট ভবিষ্যতবাণী। এভাবেই ঘটে সভ্যতার অগ্রগতি।
মার্ক্স তার ক্যাপিটাল বইতে সমাজ ও অর্থনীতির বিশ্লেষণে এই ডায়ালেক্টিকস এর এত গভীর ও বিস্তর ব্যবহার করেছেন যে, লেলিন দাবি করতেন যে হেগেলের ‘লজিক’ পুরোটা পড়ে না আসলে নাকি ক্যাপিটাল বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টারই কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না! সে দাবি একটু অতিরঞ্জন হলেও এর মধ্য দিয়ে এটা বোঝা যায় যে বস্তুবাদ আর ডায়ালেক্টিকসের গভীর ধারণা না নিয়ে মার্কসীয় তত্ত্বের অনুধাবন দুঃসাধ্য। আর জাগতিক জটিল সমস্যার সমাধানে কিভাবে ডায়ালেক্টিকসের ব্যবহার করা যায় তার এত সুন্দর উদাহরণ ক্যাপিটাল ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়াও দুষ্কর।
ক্যাপিটাল বইতে মোটেও ডায়ালেক্টিকস এর সূত্রগুলো অর্থনীতির ওপর চাপিয়ে দেননি মার্ক্স। বরং সেই সূত্রগুলো মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোর গভীর ও নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই উঠে এসেছে। ক্যাপিটাল একটা যুগান্তকারী কাজ। যা শুধু অর্থনীতি না, পুরো সমাজ বিজ্ঞানকে চিরদিনের মত পরিবর্তন করে দিয়েছে। এর আগ পর্যন্ত সবকিছুকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে প্রতিটি অংশের সুচারু বিশ্লেষণ করে পুরো ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চলতো। এই প্রবণতা বিজ্ঞানের মধ্যেও দেখা যায়। গত দেড়শ বছর বিজ্ঞানীরা সকল জ্ঞানকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে প্রতিটা অংশের আলাদা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে এসেছেন। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস একে ‘মেটাফিজিক্যাল মেথড’ বলে বহু সমালোচনা করেছেন। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে অবশেষে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই প্রবণতার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তারা এখন অনুধাবন করছেন যে কোন কিছুকে পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝতে হলে জটিল থেকে জটিলতর ‘সিমুলেশন’ পরীক্ষা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই, তা সে আবহাওয়াবিদ্যাই হোক কিংবা মলিকুলার বায়োলজি।
এটা মার্ক্সেরই কৃতিত্ব যে, অর্থনীতি থেকে এ ধরণের শর্টকাট বিশ্লেষণের বিদায় হয়েছিল ১৯ শতকে। ক্যাপিটাল এর পর থেকে ‘রবিনসন ক্রুসো’ স্টাইলের অর্থনীতির ব্যাখ্যা (… ধরি এক দ্বীপে দুজন মানুষ আছে…) একটা হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হল। আজকাল তা খালি নিম্নমানের পাঠ্যবই আর নির্বোধ গলাবাজদের মুখেই কালেভদ্রে শোনা যায় যা কেউই পাত্তা দেয় না। অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্ভিক্ষ, কিংবা বিপ্লব কখনো নির্জন দ্বীপে দু’জন মানুষের মধ্যে হয়না!
মার্ক্স সমাজ ও পলিটিক্যাল ইকোনমিকে ঐরকম দুই ব্যক্তির বা কয়েকটি পরিবারের অর্থনৈতিক বিনিময়ের সরল গুনিতক হিসেবে না ধরে একটি গুণগতভাবে ভিন্ন জটিল ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন। যে ব্যবস্থার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সর্বব্যাপী। ঠিক যেমন প্রকৃতির নিয়মগুলো সর্বব্যাপী।
মার্ক্স প্রথমবারের মত মুদ্রার বিস্তারিত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন মুদ্রা আর পন্যের মধ্যকার সম্পর্ক। দেখিয়েছেন কিভাবে এই শ্রম–ক্ষমতার কেনাবেচার মাধ্যমে মুদ্রা পুঁজিতে পরিণত হয়। শ্রম আর শ্রম–ক্ষমতার এই মৌলিক বিভাজন করতে পারাই মার্ক্সের আসল অবদান। এর থেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের আসল রূপ আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয় যা রিকার্ডো বা এডাম স্মিথ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আর এর পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সমাজের বস্তুবাদী ও দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই।
মার্ক্স তাঁর কাজ শুরু করেন পুঁজিবাদী অর্থনীতির সবচেয়ে প্রাথমিক ধারণাটি থেকেই। যা হল ‘পণ্য’। এখান থেকেই তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেন পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যকার নিয়ত দ্বন্দ্বকে। ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডে মার্ক্স পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য আর বিনিময় মূল্যের দ্বিমুখী চরিত্রকে সামনে নিয়ে আসেন।
অধিকাংশ মানুষই পণ্য বলতে তার ব্যবহারিক মূল্য তথা মানুষের চাহিদা পূরণের ক্ষমতাই বুঝে থাকেন। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ এই পণ্যের ব্যবহারিক মূল্যকে বিনিময় মূল্যে পরিণত করে। এখানে পণ্য আর ভোগের জন্য উৎপাদিত হয়না, হয় বিক্রির জন্য। এই বিনিময় মূল্য বড়ই রহস্যময়। একে দেখা খাওয়া কিংবা ব্যবহার করা যায়না। এর কোনই বস্তুবাদী অস্তিত্ব নেই। তবুও এটাই পুঁজিবাদী সমাজের পণ্যের মুল বৈশিষ্ট্য। আর এর চূড়ান্ত প্রতিফলক হল মুদ্রা, যার মধ্য দিয়ে প্রতিটি পণ্যের নিজের বিনিময় মূল্য খুঁজে নিতে হয়। এই ছোট ছোট কাগজের টুকরার কিংবা আজকালের ব্যাংক একাউন্টের নেহাত সংখ্যার কোন বস্তুবাদী সম্পর্কই নেই। এগুলো খাওয়া কিংবা পরা যায়না। কিন্তু এগুলো বিনিময়–মূল্যকে প্রকাশ করার দরুন এমন ক্ষমতা ধারণ করে যার জন্য মানুষ খুন করতেও পিছপা হয়না।
পণ্যের এই দ্বৈত চরিত্রই প্রকাশ করে পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বকে –মজুরী শ্রম বনাম পুঁজি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে মজুর তার শ্রম বিক্রি করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে আসলে বিক্রি করে তার শ্রম দেওয়ার সময়টাকে বা শ্রম ক্ষমতাকে যাকে মালিক তার নিজের সুবিধামত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করতে পারে। এই ‘শ্রম ক্ষমতা’ মোটেও কোন অপরিবর্তনীয় মান নয়। কারণ একজন মালিক একই শ্রমিককে একই সময় ধরে খাটিয়ে বিভিন্ন মূল্যের পণ্য উৎপাদন করতে পারে। আর এর ফলেই তার সামনে সুযোগ তৈরি হয় কম মজুরী দিয়ে অধিক বিনিময় মূল্যের পণ্য উৎপাদনের। আর এখান থেকেই আসে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ যা সমাজের সকল কাজ না করা মানুষের চাহিদার জোগান দেয় ভাড়া, সুদ, মুনাফা আর ট্যাক্সের মাধ্যমে। এই সম্পদ আসলে শ্রমিকেরই পাওনা, যাকে মালিক তার ন্যায্য পাওনার ব্যাপারে অন্ধকারে রেখে উচ্চ বিনিময় মুল্যের পণ্যের উৎপাদনের মাধ্যমে জড়ো করে।
যেহেতু এই পুঞ্জিভূত হওয়া সম্পদ খুব অল্প লোকের হাতে জড়ো হয়, সেহেতু জীবনধারণের পিছনে এর খরচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। ফলে এর পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। আজ পৃথিবীর প্রায় ৬০% সম্পদই এই শ্রম চুরির টাকা যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% এর হাতে গচ্ছিত। শ্রেণী সংগ্রাম আর কিছুই নয় – এই বিরাট পুঞ্জিভূত সম্পদ কিভাবে বণ্টিত হবে তার সংকট।
পরিশেষে দর্শনচর্চা নিয়ে ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডের একাংশের ভাবানুবাদ দিয়ে শেষ করতে চাই –“ডায়ালেক্টিকসের হেগেলিয় ভাববাদী রূপটির চর্চা জার্মানিতে এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, কারন তা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও মহিমান্বিত করে। অপরদিকে এর যৌক্তিক রূপ বুর্জোয়া ও মহাজ্ঞানী প্রফেসরদের কাছে স্ক্যান্ডাল ও অপাঙতেয়। কারণ এই দর্শন বর্তমান পরিস্থিতিকে তার আসল স্বরূপে বিশ্লেষণ ও রাষ্ট্রের অবশ্যম্ভাবী ভাঙনের দিকে সকলের দৃষ্টি নেয়। কারণ এই দর্শন দেখায় যে সমাজব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবে নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং বর্তমান ব্যবস্থাও চিরস্থায়ী নয়। কারণ এই দর্শন নিজের ওপর কোন কৃত্রিম ধারণা চাপিয়ে নিতে রাজি নয়। কারন এই দর্শন চরিত্রগত ভাবেই সমালোচক ও বিপ্লবী।”
লেখক: অনুজীববিজ্ঞানী, সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত ও অধ্যয়নরত।