বাংলাদেশে বড় কৃষকের সংখ্যা মোট কৃষকের শতকরা ২ ভাগ। মাঝারি কৃষক ১৮ ভাগ। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগ। এই ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকই কৃষির মূল চালিকা শক্তি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে, এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক ও দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ গ্রহণ করে। এসব ঋণের সুদ ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। আর সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে কৃষিঋণ দেয়, তার পরিমাণ মাত্র ৬ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় সিংহভাগ কৃষক সরকারি বিশেষায়িত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ পান না।
আবার এটা ঠিক যে, অনেকে কৃষক না হয়েও কৃষিঋণ গ্রহণ করছেন। সেই ঋণ তারা ব্যবহার করছেন অন্য কোনো অলাভজনক খাতে। এরাই পরে যখন খেলাপিতে পরিণত হন তখন দায় পড়ে কৃষকের ওপর।
দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-কৃষকের দরজায় ঋণ নিয়ে যাবে ব্যাংক; ব্যাংকের শাখায় চালু করতে হবে কৃষিঋণ বুথ এবং এনজিওর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমাতে হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। চিনিকলে কৃষকদের মধ্যে উপকরণ ও নগদ টাকা হিসাবে যে ঋণ বিতরণ করা হয়, তা আখ উন্নয়ন কর্মীরা (সিডিএ) কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেন। সিডিএরা শুধু ঋণই দেন না। কৃষকের আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। আখ বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি পত্র (পুর্জি) প্রদানের ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে প্রতিটি চিনিকলেই এখন শতভাগ কৃষিঋণ আদায় হয়। বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক সরাসরি কৃষিঋণ বিতরণ করে না। বরং ঋণ বিতরণের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ করে। এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের সুদ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত হয়। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের ৭০ শতাংশ বিতরণ করে এনজিওর মাধ্যমে। অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করছে ৮ শতাংশ সুদে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এনজিওগুলোর ঋণ বিতরণের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ যখনই এনজিওগুলো ঋণ বিতরণ করে, তখনই সুদের হার বেড়ে যায়। এনজিওগুলোর সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে বলা হয় বৈঠকে। দেশের সব ব্যাংক শাখায় একটি কৃষিঋণ বুথ খুলতে বলা হয়, যাতে কৃষক বুঝতে পারেন কোথায় যেতে হবে ঋণের জন্য? সভায় অংশ নেয়া ব্যাংকগুলোকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষিঋণ মেলার আয়োজন করতে বলা হয়েছে, যেখানে ব্যাংকার ও কৃষক অংশ নেবেন। কারণ কৃষকরা মাঠে ব্যস্ত থাকেন। ব্যাংকে যাওয়ার সময় তাদের নেই। তাই মেলায় অংশ নেয়া ব্যাংকগুলো কৃষকদের মাঝে তাৎক্ষণিক আবেদনপত্র বিতরণ ও গ্রহণ এবং ঋণ অনুমোদন করবে।
কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের ২.১০ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ করতে হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ ফসল, ১০ শতাংশ মাছ চাষ, ১০ শতাংশ পশুসম্পদ এবং ২০ শতাংশ অন্যান্য কৃষি উপখাতে বিতরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছিল ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।
কিছুদিন আগে ঋণের দায়ে কৃষকদের জেলে পুরে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের মনে কৃষিঋণ নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে-যে কৃষক করোনার ভয়াবহ সময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলিয়ে আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সামান্য ঋণের দায়ে জেলে যাবেন কেন? কেন তাদের কোমরে রশি পরানো হবে? আর যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হয়ে বুক ফুলিয়ে বাংলার সবুজ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়, তাদের নামে কেন মামলা হবে না-বিষয়টি মোটেও বোধগম্য নয়।
তবে এটাও পরিষ্কার যে, ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে একজন লোক আদৌ কৃষক কি না বা কৃষিকাজ করার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রশিক্ষণ আছে কি না, তা যাচাই না করেই ঋণ বিতরণ করে থাকে। তাই আমাদের কথা, কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন খাতে ঋণের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর থাকতে হবে পূর্ব অভিজ্ঞতা। এছাড়া উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষককে বাঁচানোর জন্য থাকতে হবে কৃষি বীমার ব্যবস্থা। এসব ছাড়া কৃষিঋণ বিতরণ একবারেই অর্থহীন।
লেখক: কৃষিবিদ ও কলামিস্ট এবং সাধারণ সম্পাদক ময়মনসিংহ জেলা ওয়ার্কার্স পার্টি।