।। নিতাই চন্দ্র রায় ।।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৬ সালেরর ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লাখো জনতার যে ঐতহাসিক লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়, তার জন্য তিনি এই নদীমাতৃক বাংলাদেশে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, নদীর কুলকুল ধ্বনী থাকবে, মাঝি-মল্লা থাকবে,ভাটিয়ালী গান থাকবে, ততদিন উচ্চারিত হবে এই মহান নেতার নাম। নদী রক্ষায়, প্রাণ-প্রকৃতি, কৃষি ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় এই দিবসটি পালিত হবে অগনিত মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার উচ্চাঙ্গ সংগীতে।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে । ১৬ মে সকাল ১০ টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। দুপুর ২ টায় মানুষের স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলা গ্রামে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ছয়টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাত্রি যাপনের জন্য সেদিনের জন্য শেষ হয়। মাঠে রাত যাপন করার পরদিন সকাল আটটায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। কী অবাক কাণ্ড! হাজার হাজার মানুষ নিজেরাই নৌকা দিয়ে সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হয়ে ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছে। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর অগনিত জনতার সমাবেশ থেকে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভারতের উদ্দেশ্যে তাঁর জ¦ালাময়ী বিদ্যুত ভাষণে বলেন, ‘ তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।’
প্রতিবেশী দেশ ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের ফলে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলছে। পদ্মা পানির অভাবে শুকিয়ে ধু ধু বালু চর।একই কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণ অঞ্চলের অন্তত ৩০ টি নদী বিলুপ্তির পথে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে ১০০ থেকে ১৬০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। নিচে নেমে গেছে রাজশাহী নগরীতে পানির স্তর ৬০ থেকে ৭০ ফুট পর্যন্ত ।
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য নৌপরিবহন,শিল্প, বনজসম্পদ ও পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় বাংলাদেশের কৃষি। পানির স্তর বহু নিচে নেমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাটির আর্দ্রতা হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষিকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়. ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত শুধু কৃষিক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয় বছরে ৫০০ কোটি টাকার ওপর। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সেখানকার প্রধান অর্থকরী গাছ সুন্দরী ধ্বসের মুখে।
গঙ্গার পানির ওপর পদ্মা নদীর পাশর্^বর্তী এলাকার প্রায় দুই শতেরও বেশি মাছের প্রজাতি এবং ১৮ প্রজাতির চিংড়ি নির্ভর করে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে মাছের সরবরাহ কমে যায় এবং হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়ে। আজ থেকে এক চল্লিশ বছর আগে গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ চালু করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পানি প্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে নিয়ে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা। সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না হলেও ফারাক্কার কারণে গঙ্গার উজানে যে পলি পড়া শুরু হয়েছে তার প্রভাবে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে বন্যা কবলিত হয়ে পড়ছে বিহার ও উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বহুদিন ধরেই মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী দুর্ভোগ ও বিপর্যয় কবলিত মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। একই সঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণ, ভূমি ও পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জন্যও ফারাক্কা বাঁধ বড় ধরনের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু পশ্চিবঙ্গ নয়, পাশর্^বর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে প্রায় প্রতিবছর বন্যায় লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমতে থাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদী ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবে গৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্ত থেকে জানা যায়, প্রথম ১০ দিনে ফারাক্কায় ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম পানির প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশও ভারত উভয়েই ৫০ শতাংশ করে পানি পাবে। দ্বিতীয় ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ হাজার কিউসেক থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। তৃতীয় ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্টে ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার চেয়ে বেশি পানি থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ। তবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশ তিন দফা ১০ দিনের হিসাবে ক্রমানুসারে ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহীর পদ্মার সেই অপরূপা যৌবন ও সৌন্দর্য আর ন্ইে। এ ছাড়া জেলার বাঘা, চারঘাট ও গোদাগাড়ীতে পদ্মার শাখা নদীতে একই চিত্র বিদ্যমান।
ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশে প্রতিবছর বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে স্থায়ী সমাধান চেয়ে আসছেন। একই দাবী বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদেরও। কেননা এই বাঁধের কারণে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের বেশ কিছু জেলা বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের কবলে পতিত হয়। এ ছাড়া গ্রীষ্ম মৌসুমে ভারত পানি আটকে রাখায় বাংলাদেশ প্রয়োজনের সময় পানি পাচ্ছে না, যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে কৃষি, বন, মৎস্য চাষ , নৌপরিবহনে; সর্বোপরি আবহাওয়ার ওপর , যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের বিপর্যয় ডেকে আনছে।
মওলানা ভাসানী একবার পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। দেশে ফেরার সময় করাচির মেয়র মহান নেতাকে এক গণ সংবর্ধনা প্রদান করেন। তাকে এক নজর দেখার জন্য লাখো মানুষের ভিড় হয় ওই সংবর্ধনা সভায়। মওলানা ভাসানী যখন লুঙ্গি, পাঞ্জাবী ও বেতের টুপি পড়ে মঞ্চে উঠলেন তখন জনতা বললো ইয়ে মিসকিন হ্যায়। পবিত্র কোরআনের সুরা পাঠের মাধ্যমে তিনি যখন ভাষণ শুরু করলেন , তখন সেই জনতাই বললো- ইয়ে মওলানা হ্যায়। তিনি যখন ইসলামের আদর্শের আলোকে প্রাঞ্জল ভাষায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেন তখন জনতা বললো , ইয়ে কমুনিষ্ট হ্যায়। তিনি যখন সারা বিশ্বের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন শোষণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বক্তব্য রাখলেন তখন জনতা উচ্চ স্বরে বলতে লাগলো- ইয়ে স্টেটম্যান হ্যায়। মওলানা ভাসানী সত্য সত্যই একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন।তিনি জানতেন ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।বিপন্ন হবে কৃষি , মৎস্য , জীববৈচিত্র ও পরিবেশ।
মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভারত নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তার দূরদৃষ্টি দিয়ে আজ থেকে বহু বছর আগে। আর সে কারণেই ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহতা সর্ম্পকে বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে ১৯৭৬ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ।
লেখক: সভাপতি, বাংরাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ত্রিশাল উপজেলা, ময়ময়নসিংহ।