সীমান্ত শব্দটি শুনলেই গা কেমন শিউরে উঠে। চোখের সামনে ভেসে উঠে বন্দুক হাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টহল। সব সময় একটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার দৃশ্যপট চোখে ভেসে আসে। ছোট বেলা থেকেই সীমান্ত বলতেই এই ভয়গুলো মনের ভেতরে কাজ করতো। এই ভয়টি আমার বাস্তবরুপ নেয় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হতো। তবে ৭ জানুয়ারির সকালটা ছিলো একটু ভিন্ন রকম। দেশ ও বিদেশি গণমাধ্যম শিরোনাম হলো বাংলাদের কুড়িগ্রামের মেয়ে ফেলানী। মেয়েটি বাবার সাথে নয়াদিল্লীতে গৃহকর্মীর কাজ করতো। দেশে মেয়ের বিবাহ দেওয়ার জন্য মেয়েকে নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরছিলো বাবা। কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরখুঠি এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর সদস্যরা কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পর ফেলানীর লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে রেখেছিলো। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। ফেলানী হত্যার ন্যায়-বিচার বাংলাদেশ যে পাইনি সেই বিষয়ে বিতর্কে আমি জড়াবো না।
সর্বশেষ গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী গত ১০ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বেউরঝাড়ি সীমান্তের নাগর নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বিএসএফ’র গুলিতে সফিকুল ইসলাম ওরফে ফুটা নামের এক বাংলাদেশী মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সফিকুল ইসলাম সহ কয়েকজন বেউরঝাড়ি সীমান্তের নাগর নদীতে মাছ ধরতে গেলে ভারতের অভ্যন্তরে ৩৮৩/২ এস পিলার এলাকায় তারকাটার ওপার থেকে ভারতের উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপুকুর থানার নটুয়াটুলি ক্যাম্পের বিএসএফ জোয়ানরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এ সময় অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও সফিকুল ঘটনাস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
স্বাধীনতার পর থেকে এরকম হাজারো প্রাণ ঝড়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। এই রকম হাজারো ফেলানী ও সফিকুলের জীবনের গল্প নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। শতশত স্বপ্ন আর হাজারো পরিবারের কর্মক্ষম একমাত্র মানুষটিকে হারিয়ে কত পরিবার নিঃস হচ্ছে। অথচ আমাদের কথিত বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে যে কয়টা দেশের সীমান্ত রয়েছে তারমধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সাথে ভারতে কোনো বিরোধপূর্ণ সীমান্ত নেই। তার পরেও শুধু মাত্র বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে প্রতি বছর অকালে অনেক বাংলাদেশির প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আর পর উভয় দেশ নিজেদের পরস্পর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করছে। অথচ গত দশ বছরে বাংলাদেশ ভারত-সীমান্তে ২৯৪ জন মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ২০০৯ সালে মোট ৬৬ জন। আর সব চেয়ে কম হত্যাকাÐ ঘটেছে ২০১৮ সালে ১৪ জন। তবে আইন ও শালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী হত্যাকাÐের পরিসংখ্যানটা আরো বেশি। আর চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩০ জন বাংলাদেশি হত্যাকাÐ ও ১৮ বাংলাদেশির নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে। এমন চিত্র তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা।
পৃথিবীর যেকোনো সীমান্তে সীমান্তরক্ষীদের দ্বারা একজন মানুষ হত্যার শিকার হলেও সেটা বিরাট শিরোনাম হয়। আমেরিকা-মেক্সিকো, ইজরাইল-ফিলিস্থিন,ভারত-পাকিস্থান সীমান্তে যদি এরকম ঘটনা ঘটে তাহলে বিরাট শোরগোল তৈরি হয়। ইদানিং ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ বাস্তব উদাহরণ। আর ভারত-নেপালের আধুনিককালের ইতিহাসে ২০১৬ আরেক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সশস্ত্র সীমা বল বা এসএসবি নেপাল সীমান্তে এক বিরোধের ঘটনায় গুলি চালিয়ে এক নেপালীকে হত্যা করে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সে দেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া। এ হত্যার ঘটনায় প্রায় সমগ্র নেপাল প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এ হত্যার জন্য নেপালের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বা করতে বাধ্য হয়। আর বাংলাদেশ সীমান্তে গত প্রায় দুই দশক ধরে গুলি চালিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করেও ভারত দুঃখ প্রকাশ করে না, বা করার প্রয়োজনও বোধ করে না।
যদি প্রশ্ন করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত কোনটি? এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের মনে ভেসে উঠতে পারে ফিলিস্তিনিদের গাজা ভূখÐের সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তের কথা। কেননা, বছরের পর বছর সেখানকার বহু ফিলিস্তিনির নিষ্ঠুর হত্যার খবর বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। অন্য আর যে সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে প্রাণহানির কথা শোনা যেত, সেটি হলো আমেরিকা মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর সীমান্ত। কিন্তু গুগলে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে এই প্রশ্নের উত্তরটি হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। কেননা, সংখ্যার দিক থেকে সীমান্তে প্রাণহানিতে বিশ্ব রেকর্ডটি আমাদেরই। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে হতাহতের সবাই না হলেও অন্তত ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি।
অথচ দুই দেশের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেফতার ও হস্তান্তরে সমঝোতা এবং চুক্তি থাকলেও বিএসএফ সেটি লঙ্ঘন করে সীমান্তে বাংলাদেশিদের দেখামাত্রই গুলি করছে। বিজিবি এসব হত্যার প্রতিবাদ জানাতে মাঝেমধ্যে পতাকা বৈঠক ডাকে। সব সময়ই নিয়মমাফিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু হত্যা বন্ধ হয় না। এমনকি হত্যার পর সব সময় লাশও ফেরত দেয় না বিএসএফ। নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা ও অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার খুবই স্বাভাবিক ঘটনা সীমান্ত এলাকার মানুষের কাছে।
আশ্চর্য যে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই গরু ব্যবসায়ী। ভারত থেকে গরু এনে বাংলাদেশে বিক্রি করা অধিক লাভজনক। সেই অতিরিক্ত লাভের আশায় তারা গরু আনতে ভারতে যায়। একটি অংশ যায় বৈধভাবে। তাদের পাশাপাশি কিছু অবৈধ গরু ব্যবসায়ী বা রাখালও হয়তো ভারতে প্রবেশ করে। তারা যখন ভারতে প্রবেশ করে তখন বিএসএফ কখনো তাদের বাধা দেয় না বা হত্যা করে না। হত্যা করে তখন যখন তারা গরু নিয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। শোনা যায় যে, উৎকোচের টাকার পরিমাণ নিয়ে বিরোধ থেকেই তারা বিএসএফের ক্রোধের শিকার হয়ে প্রাণ হারায়। এসব গরু ব্যবসায়ী কোনো সন্ত্রাসী বা নাশকতামূলক কাজে জড়িত নয়। শুধু অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশের জন্য আরেক দেশের মানুষকে নিয়মিতভাবে গুলি করে বা পিটিয়ে হত্যার দৃষ্টান্ত শুধু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর।
আর এইসব আগ্রাসী ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হচ্ছে। শুধু সীমান্ত হত্যা নয় বরং নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবসা নীতিতেও ভারত বাংলাদেশের সাথে বছরের পর বছর অন্যায় করে আসছে। বাংলাদের কাছে ভারত নানা সুবিধা গ্রহণ করলেও বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্নে ভারতের নীরবতা আমাদের হতাশ করেছে। যার ফলশ্রæতিতে তরুণ প্রজন্ম বন্ধু রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করার দাবি তুলেছে। যা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা।
অপর দিকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিক নির্যাতন ও হত্যার শিকার হলেও বাংলাদেশ অজানা কারণে কোনো জোরালো প্রতিবাদ করে না। যা দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাই সিমান্ত হত্যা বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা থাকাটাও জরুরি। সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করবো সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
লেখকঃ আব্দুর রউফ, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।