রবিবার,৭,ডিসেম্বর,২০২৫
18 C
Dhaka
রবিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতবাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটা বৈশ্বিক ঘটনা:  ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রবণতা...

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটা বৈশ্বিক ঘটনা:  ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রবণতা কেনো!/?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটা বৈশ্বিক ঘটনা : শ্রীনাথ রাঘবন: স্বাধীনতার ইতিহাস লেখার দৃষ্টিভঙ্গী এবং ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীর বহুমাত্রিকতা: ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রবণতা কেনো!/?
১৯৭১সাল বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বছর। দীর্ঘ নয় মাসের ( মার্চ-ডিসেম্বর) যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিজয় এবং একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এই অর্জনকে বাংলাদেশ ভূখন্ডের বাঙালির এক ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে হিসেবে দেখা হয়। দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন একটা জাতির পরিপূর্ণতা হলো তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সেই হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙালির জাতি হিসেবে একটি পূর্ণতা। কিন্তু এই নিয়ে এখন বেশ তর্কবির্তক হচ্ছে। এই তর্ক বির্তক অবশ্যই রাজনৈতিক। রাজনীতিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ইতিহাসকে স্বীকার অস্বীকারের পালা চলছে। প্রশ্ন হলো- চুয়ান্ন বছর পরেও এই বিতর্ক কেনো? এই প্রশ্নের কিছু জবাব শ্রীনাথ রঘুবানের 1971- আ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্যা ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ – নামক বইতে আছে।
রাঘবান তাঁর বইতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকে একটা বৈশ্বিক ঘটনা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, শীতল যুদ্ধের সময় যখন পৃথিবী রাজনৈতিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্র বনাম  সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটে বিভক্ত ছিল ; সেই আমলের একটা রাজনৈতিক ঘটনা হলো – বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
সাধারণত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে এদেশের স্বায়ত্তশাসন থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহাসিকগণ এটাকে পাকিস্তানের শোষণ নিপীড়ন বা প্রায় উপনিবেশিক শাসন থেকে তার পূর্বাংশের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন হিসেবে প্রধানত দেখান। এরমধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র দর্শন দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের আত্তীকরণের ব্যর্থতা হিসেবেও অনেকে দেখেন। এই স্বাধীনতা অর্জন বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তার পঁচিশ (১৯৪৭-১৯৭১) বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের যার অন্তর্ভুক্ত হলো ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব,  কনফেডারেশন ইত্যাদি সহ অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং গণঅভ্যুত্থান। তারপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অস্বীকার এবং তাদের নয়মাসব্যাপী গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা একটা মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্টি করেছিল। প্রবাসী সরকার,  সেক্টরে বিভক্ত,  গেরিলা বাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মিত্র বাহিনী এবং ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয়  – এগুলোও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সরল ধারাবাহিকতা। কিন্তু এগুলোকে এখন বেশ প্রশ্ন করার রাজনৈতিক প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। তার উত্তরও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে জানা যাবে বা বোঝা যাবে।
শ্রীনাথ রাঘবান বৈশ্বিক বলতে,  পাকিস্তান,  ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে মূলত বুঝিয়েছেন। পাকিস্তানের অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ।  তাই পাকিস্তান একটা বড় অভিনেতা।  দ্বিতীয় হলো, ভারত, পূর্ব বাংলা বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অংশ ছিল,  দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনৈতিক অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।  তারপর, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক বিকাশ এবং জাতীয়তার প্রশ্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশকে পাকিস্তানের হিন্দু ও ভারতের দালাল আখ্যায়িত করা, আগরতলা ষড়যন্ত্র,  ছয়দফা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য ভারতে শরণার্থী হওয়া এবং ভারতে প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ- সবই ভারতের সহযোগিতায় সম্পন্ন হওয়ায় ভারতের যুক্ত হওয়া।  এরপর বৈশ্বিক জোট। পাকিস্তানের পক্ষে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা অন্য দিকে ভারতের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলাদেশের জন্মে তাই ভারত- সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটের জয়লাভ একটা বৈশ্বিক ঘটনায় পরিণত হয়। ভারত বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশী।
এখন এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখলে এটা বোঝা সহজ যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানের দৃষ্টিতে ভারতের,  হিন্দুদের,  আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র এবং  ইসলামের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। কারণ পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র। চীন মনে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন,  কিসিঞ্জারের মতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আসলে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম। অন্য দিকে,  ভারতের অনেক ঐতিহাসিক ও জেনারেল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারতের সহযোগিতা,  বন্ধুত্ব এবং ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের পূর্বান্চলে ভারতের বিজয় বা পাকিস্তানের পরাজয় হিসেবে দেখেন বা লেখেন।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ শে মার্চ১৯৭১ থেকে,  পূর্ব পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের জনগণ এবং গেরিলা বা মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ক্রমাগত পরাজিত করেছে। বিপুল আত্মত্যাগ করেছে।  ত্রিশ লক্ষ শহীদ হয়েছে, দুই লক্ষের অধিক নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন- এই সবই বাংলাদেশের মানুষের অর্জন- এগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধকে বিজয়ের নায়কে পরিণত করার প্রবণতা পাকিস্তানী প্রোপাগান্ডাকে ইন্দন যোগায়। এরপর আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন।  আগস্ট সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এর দিকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তি বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশকে ভারতের সমর্থন একটা জোরালো ভিত্তি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর ক্ষমতাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন চ্যালেন্জ করতে শুরু করে। সবশেষে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জাহাজের বিপরীতে সোভিয়েত নৌ যুদ্ধ জাহাজের আগমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয়কে বৈশ্বিকভাবে সহজ করে দেয়। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের জন্মকে পাকিস্তান চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয় এবং ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় হিসেবে দেখানোর একটা ঐতিহাসিক প্রবণতা দেখা যায়।  যেমন বলা যায়,  পৃথিবী সূর্যের চারি দিকে ঘুরে নাকি সূর্য ঘোরে দেখে পৃথিবীও ঘোরে – এই রকম একটা ধাঁধা বলার মতো। অথচ সহজ সত্য হলো পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে আবার সূর্যও ঘুরে।  তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটা বাংলাদেশের বিজয় এবং এট একই সাথে একটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক ঘটনা।
আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অনেকে পাকিস্তানের দৃষ্টিতে দেখে। এটা প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা।  অন্যদিকে,  বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের বিজয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জনগণের অর্জন এই অর্জনে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মিত্র এবং পাকিস্তান আমাদের শত্রু ছিল।  এর বাইরে গেলে ঐতিহাসিক বিচ্যুতি হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জনগণের ত্যাগতিতিক্ষা এবং রাজনৈতিক সামরিক বিজয়। বাংলাদেশের এই অর্জন একটা বৈশ্বিক ঘটনা। এটাকে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা একটা অপরাধ তেমনি এটাকে পাক ভারত যুদ্ধের ফল হিসেবেও দেখার সুযোগ নেই।  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় যেখানে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মিত্র ছিল। মাত্র চুয়ান্ন বছর। মহাকালের হিসেবে কম। আরও সময় গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হবে।  দূর্ভাগ্য এখন বিদেশি লেখকদের উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ঐতিহাসিকরা একদিন বাংলাদেশের জন্মের বা স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন যেখানে বাংলাদেশ হবে সূর্য এবং বিশ্ব হবে তার পৃথিবী। বাংলাদেশের বাঙালির রাষ্ট্র অর্জন অনেক গৌরব ও মহৎ বিশ্বরাজনৈতিক ঘটনা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ