।। রাশেদ খান মেনন ।।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ তথা মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচজন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান বাংলাদেশে আসছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রথমে এটাকে ‘উদযাপন’ বলে আখ্যায়িত করলেও পরবর্তীতে বলেছেন যে এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে।
মুজিববর্ষ বা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছর বছর আসে না। যেখানে কোন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সফর কর্মসূচির জন্য বেশ সময় ও প্রস্তুতির ব্যাপার সেখানে কোন উৎসব উপলক্ষে এসব শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্বের সফর বিশেষ কূটনৈতিক মূল্য বহন করবে সেটাই স্বাভাবিক এবং কোন যোগ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় এই সুযোগকে কাজে লাগাবেন সেটাও স্বাভাবিক। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রথম কথামতে তাদের এই সফর মূলগতভাবে ‘উদযাপনে’ সীমাবদ্ধ থাকবে, তারপরও রাষ্ট্রীয় শীর্ষ নেতৃত্বের পরস্পরের সাক্ষাত, আলোচনা ঐ কূটনৈতিক কাজকে এগিয়ে নেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী এ সকল সফরের সময় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ভারতের সাথে এ যাবতকালে যে সব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে তার বাস্তবায়নের বিষয়েও আলাপ হবে। এ কারণে মোদীর সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছাড়াও দু’দেশের কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠক হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের কোন দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নাই। আর সেসব দেশের সাথে বাংলাদেশের কোন সরাসরি সীমান্তও নাই। এর মাঝে ভূটান ও নেপালের সাথে সড়ক বা রেলপথে যোগাযোগ করতে হলে ভারতের মধ্য দিয়েই তা করতে হবে। ভারতের সাথে সাম্প্রতিক সময় ‘কানেকটিভিটি’ বা ‘যোগাযোগে’র ক্ষেত্রে সম্পর্কের যে সিদ্ধান্তবলী হয়েছে অথবা প্রক্রিয়ায় আছে তাতে এই উভয় দেশ বাংলাদেশের সাথে দ্রুতই সংযুক্ত হবে বলে আশা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সর্বশেষ সফরে তিনি ভারতসহ দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোর ‘কানেকটিভিটি’র উপর জোর দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতিও হয়েছে বলে জানা যায়।
আসলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের এই যোগাযোগের বিষয় ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধের পর একেবারেই থেমে গিয়েছিল। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ- যা ট্রানজিট ও ক্ষেত্র বিশেষে ট্রান্সশিপমেন্ট নামে সাধারণভাবে পরিচিত তা রাজনৈতিক বিরোধীতার কারণে সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ও পরবর্তীতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার-এ বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে পৌঁছেছে। বরং বলাচলে ভারতের মোদী সরকারের নেতৃত্বাধীনে সড়ক, রেল, নৌ, এমনকি বিমান পরিবহনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগের উলম্ফন ঘটেছে। তবে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভূটানের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখনও বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে যা দূর করা গেলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যোগাযোগের ‘হাব’ অর্থাৎ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। কোন পরিবর্তন না হলে উভয় সরকারই আর বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় আছে। ফলে তাদের আমলে উভয় দেশের কানেকটিভিটি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের কানেকটিভিটিতে সার্থক রূপ নেমে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে হাসিনা-মোদী’র ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নটিও গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের প্রাচীণ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সম্পর্ক অত্যন্ত পুরাতন ও ঘনিষ্ঠ। কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকলেও এই সম্পর্ক এখনও বিদ্যমান। কোভিড-১৯ সংক্রমণ না ঘটলে মুজিববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কেবল কংগ্রেস নয়, ভারতে বাম রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকেও দেখা যেত। তবে বিজেপি সরকারের সাথে সেই সম্পর্ক কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। এ ক্ষেত্রে হাসিনা ও মোদীর উভয়ের দূরদর্শিতা প্রধান ভূমিকা রেখেছে। মোদী সরকার তার রাজনৈতিক প্রয়োজনেই ‘প্রতিবেশী প্রথম’ এই নীতি নিয়ে এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মোদী পাকিস্তানের সাথেও তার সম্পর্ক উন্নতির বিশেষ চেষ্টা করেছে। মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরীফকে আমন্ত্রণ অথবা মোদীর পাকিস্তান গমন এ সবই দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ কিছুটা এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি জঙ্গিবাদীদের আক্রমণ ও সন্ত্রাসী ঘটনা সে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্থই করেনি কেবল, একেবারে নামিয়ে দিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ-আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ- এসব কথা সুবিদিত। সে ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই একযুগে সর্বাপেক্ষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা দীর্ঘ চল্লিশ-একচল্লিশ বছর ধরে ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল বিনিময়ের ঘটনা। সংবিধান ও সুপ্রীম কোর্টের কথা বলে ঐ বিষয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্ব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা কেবল এটা সম্ভবই করেনি, ভারতের লোকসভায় অভূতপূর্ব ঐক্যের মধ্য দিয়ে ঐ স্থল সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা নির্ধারণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তারও সমাপ্তি হয়েছে সফলভাবে। ভারত সরকার এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সম্প্রতি আকাশপথের ক্ষেত্রেও সীমানা নির্ধারণে চিঠিপত্র আদান-প্রদান হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আকাশপথে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্যারিফ বাধা অধিকাংশই দূর হয়েছে। তবে সেই পুরান দিনের মত নন-ট্যারিফ বাধাগুলো এখনও বিদ্যমান। ভারতের পাটকলগুলো বাংলাদেশের পাটের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল হলেও, ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যের ক্ষেত্রে যে এ্যান্টি-ডাম্পিং ল’ ব্যবহার করছে তাতে বাংলাদেশের পাটকলগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের পাটকলগুলোর অব্যাহত যে লোকসান দেখিয়ে পাট মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে তাতে এই ভারতের এ্যান্টি-ডাম্পিং আইনের কারণে লোকসান দেয়ার কথা পাটমন্ত্রী উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্যে কিছুটা ভারসাম্য আনতে হলে বাণিজ্য বিষয়ক এই বাধাগুলো দূর করা প্রয়োজন।
তবে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা এখনও বাধা হয়ে রয়েছে তার প্রধান হলো সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা। বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ের প্রতি আলোচনাতেই এটা বন্ধ করার কথা বলা হয় কিন্তু বন্ধ হয় না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ জন্য সীমান্তে অপরাধকে কারণ বলে উল্লেখ করছেন। তবে এই অপরাধকর্ম একতরফা নয়, দোতরফা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে একই যুক্তি পুনরুল্লেখ করেছেন। এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বিজিবি’র কর্মকর্তারাও যে এটা মেনে নিয়েছেন সেটা তাদের কথাবার্তায় মনে হয়। কিন্তু ভারতের দেয়া নিজেদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হলে কাটা তাঁরের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিষদময় স্মৃতি হিসেবে এদেশের জনগণের মনে জ্বলবে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি সর্বাপেক্ষা পীড়া দিচ্ছে তা’হল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন। এ নিয়ে তিস্তা চুক্তি হয়ে গেছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য বেশ বড় ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ঐ চুক্তির পাতায় পাতায় স্বাক্ষর হয়ে গেছে কেবল বাস্তবায়ন বাকী- এ দ্বারা তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন তা তিনি ভাল জানেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে ঐ চুক্তি স্বাক্ষরের সব আনুষ্ঠানিকতা প্রায় সম্পন্ন হলেও, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে সেটা শেষ পর্যন্ত আর আলো দেখেনি। পরবর্তীতে নরেন্দ্র মোদী কয়েক দফা সফরে বিষয়টা উঠলেও ভারতের ফেডারেলিজমের কথা বলে তা আর হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী তার সর্বশেষ সফরে স্পষ্ট করেই বলেছেন এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থান একই আছে। সেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উক্তি মানুষকে হতবাক করেছে। বরং সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে তিনি একটা কাটা ফুটিয়ে দিলেন বলেই মনে হয়! আর এ ক্ষেত্রে নন্দীগ্রামে নির্বাচনী প্রচার করতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জী যে কথা বলেছেন তাতে তিনি জিতলে যে তিস্তা একেবারেই মরুভূমিতে পরিণত হবে সেটা বরং বোঝা যায়। অর্থাৎ তিস্তার ভাগ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বলি হবার সম্ভাবনা। তিস্তার ভাগ্য কি হবে নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের উপর। এদিকে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম ‘প্রথম আলো’র এক লেখায় শুকিয়ে যাওয়া তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি ও ভাঙ্গন রোধের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে তাতে ভারত আপত্তি করছে বলে বলেছেন। এটা সত্য হলে বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের যে অধ্যায় হাসিনা-মোদী আমলে হয়েছে তাকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে সম্পর্কিত ও রক্তের। পঁচাত্তর পরবর্তীতে বহু টান-পোড়নের মধ্য দিয়ে সেটা এগিয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি বরাবরই এই সম্পর্ককে সেই রঙেই রঞ্জিত করেছে। বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতেও সেটা মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইবে। কিন্তু গত এক যুগে এই সম্পর্ক যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এবং তাতে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর যে ভূমিকা সেটাকে ধরে তাকে আরও উন্নত করাই হবে বরং কর্তব্য। সুবর্ণ জয়ন্তীর আলোকে সেই সম্পর্ক আরো আলোকিত হোক। কেবল ভারত-বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়াকেও আলোকিত করুক সেটাই আশা করে সবাই।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।