ঢাকা প্রতিনিধিঃ মুক্তিযুদ্ধ দেশ দিয়েছে, কিন্তু পঞ্চাশ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রেক্ষাপটে কোন পরিবর্তন হয়নি। আগে ছিল পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের দুই অর্থনীতি, এখন সেই দুই অর্থনীতি ব্যপ্ত হয়েছে ধনী আর দরিদ্রের দুই অর্থনীতিতে। শহর আর গ্রামের দুই সমাজে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী শাসকরা ধর্মের আবরণ নিয়ে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, লুট করেছে। এখন ধর্মের আচরণ সবখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য ছোবল পড়ছে মাঝে মাঝেই। কিন্তু যারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছে তারাই সাম্প্রদায়িক তান্ডবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। খুব সহজেই এখন জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার কথা বলা যায়, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনেই ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের দাবি করা যায়।
জেলখানা থেকে আলেম-ওলামার নামে দুষ্কৃতিকারীদের মুক্ত করার কথা বলা হয়। পাকিস্তানী আমলে রাষ্ট্র অর্থনীতি সামরিক-বেসামরিক আমলা ও বাইশ পরিবারের হাতে বন্দী ছিল, এখন তার পরিসর আরও সংকীর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্র এখন বন্দী ক্ষুদ্র অতিধনী আর সামরিক-বেসামরিক আমলা নেতৃত্বের হাতে। পঞ্চাশ বছরে পাকিস্তানী অতীতের পরিবর্তন আসে নাই বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা অস্বীকৃত। কারণ ’৪৮ থেকে ’৭১ পর্যন্ত, এমনকি বাংলাদেশ পরবর্তীকালেও বামপন্থীরা লড়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য।
আর তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বীকৃত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে সংবিধানে রূপ দিয়েছিলেন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের নামে। বাহাত্তরের সংবিধানের খোলসটি রয়েছে কিন্তু তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অন্তর্ধান করেছে। চল্লিশ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে, যদি পরিবর্তন না ঘটানো না যায় তবে সেই বাংলাদেশের চেহারাটি কেমন হবে এখনই তা বোঝা যায়। তাই বামপন্থীদের শাসকদের অস্বীকৃতির জন্য আফসোস না করে, জনগণের স্বীকৃতির জন্য লড়াই করতে হবে।
আজ ২২ ফেব্রুয়ারি ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ ঘোষণার ৫২তম বার্ষিকীতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বামপন্থীদের ভূমিকা ও বর্তমান প্রেক্ষিত’ শীর্ষক আলোচনা সভায় পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি একথা বলেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ সালে বাইশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) আয়োজিত পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা ঘোষণা ও তার ১১ দফা কর্মসূচি প্রদানের জন্য ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদালতে সভার বক্তা কাজী জাফর, রাশেদ খান মেননকে সাতবছর সশ্রম কারাদ- ও তাদের সম্পত্তির ৬০% ভাগ বাজেয়াপ্ত করা ও মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে এক বছরের কারাদন্ড প্রদান করে।
চট্টগ্রামেও অনুরূপ ঘোষণার জন্য আব্দুল্লাহ আল নোমান ও কাজী সিরাজকে সামরিক আদালত এক বছর কারাদ- প্রদান করে। মাহবুব উল্লাহ গ্রেফতার হয়ে যান ও অন্যরা আত্মগোপনরত অবস্থায় পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণে শ্রমিক-কৃষক ও ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এরাই ১৯৭১ এর জুন মাসে মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে দেশের ১৮টি অঞ্চলে কয়েক হাজার যোদ্ধা তৈরী করে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন ও বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত্রু মুক্ত রাখেন।
আলোচনা সভায় ঐ সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো, মুক্তিযুদ্ধকালে শিবপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে শিবপুর অঞ্চলে একজনও রাজাকার হয় নাই।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেই রাজশাহী এখন জামাত-জঙ্গিবাদের জায়গা। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না আসলে আগামী দিনে তাদের ঐ শক্তির সাথেই ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে হবে।
উন্নয়নকর্মী ও সাবেক বামনেতা শামসুল হুদা বলেন, উন্নয়নের সাথে জনগণের যুক্ততা না থাকলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে না। তিনি উন্নয়ন কর্মীদের রাজনীতি ঘনিষ্ট হতে আহবান জানান।
পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য মাহমুদুল হাসান মানিক দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধে বর্ণনা দেন এবং বলেন, মুক্তিযুদ্ধে কৃষকই ছিল প্রধান সহায়ক। এখন উন্নয়নের তারাই অগ্রনী অথচ উল্লেক্ষিত গোষ্ঠী। আলোচনা সভা সঞ্চালন করেন, পলিটব্যুরো সদস্য কামরূল আহসান। শুরুতে জাতীয় সংগীত ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীত দিয়ে আলোচনা শুরু হয়।