Site icon নতুন কথা

বায়ুদূষণ মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর

# বিশ্ব দূষিত নগরীর শীর্ষ স্থান ঢাকার দখলে

# দেশীয় সমীক্ষণে শীর্ষে গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ

নতুন কথা প্রতিবেদন ॥ বিশ্বমহামারী করোনায় বিপর্যস্ত দুনিয়া, আতঙ্কিত বাংলাদেশ। কিন্তু ‘মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর বায়ুদূষণ’-বলছেন গবেষকরা। বায়ুদূষণ কারণে মরণব্যাধি ক্যান্সার তো হয়’ই, সাথে সাথে বাড়ে নানা জটিল রোগ। এমনকি মানুষের গড় আয়ুতেও আঘাত হানে। গবেষণা প্রতিবেদন আরো বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে অকালে মারা যাচ্ছেন ৮৮ লাখ মানুষ। এছাড়াও এর ক্ষতিকর প্রভাবে ম্যালেরিয়ার তুলনায় ১৯ গুণ এবং এইডসের তুলনায় ৯ গুণ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। ৬ শতাংশ মানুষ মরছেন ফুসফুস ক্যান্সারে। গবেষকদের মতে বায়ুদূষণ ধূমপানের চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর। -এমন ভয়ঙ্কর তথ্যের মধ্যেই জানাগেছে, বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থান রাজধানী ঢাকার দখলে। গত ১৯ জানুয়ারি এ তথ্য এসেছে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে। আর এই প্রথম দেশীয় বায়ুমান গবেষণায় ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় অস্থানে থাকলেও গত ৬ বছরে ২১৯০ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ বিশুদ্ধ বায়ু পেয়েছে মাত্র ৩৮ দিন। এ তথ্য উঠে এসেছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) গবেষণায়। ওই গবেষণা অনুযায়ী দেশীয় বায়ুমাণে দূষণের শীর্ষে রয়েছে গাজীপুর আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ। দুটো নগরী’ই রাজধানী ঢাকার অদূরে। এছাড়া চতুর্থ থেকে দশম স্থানে থাকা জেলাগুলো হলো হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ। প্রতিবেদনে ১৮টি জেলার বায়ুর মান অতিরিক্ত দূষিত। ১০ জেলার বায়ুর মান ভালো, মোটামুটি ভালো ৩৬ জেলা। সবচেয়ে কম দূষিত জেলা শহর হলো মাদারীপুর।
জানাগেছে, বিশ্ব বায়ুদূষণ সূচক প্রতিবেদনে ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২৬৯। যার অর্থ হলো জনবহুল এ শহরের বাতাসের মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়েছে। ৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘দেশব্যাপি ৬৪ জেলার বায়ুমান সমীক্ষা-২০২১’-শীর্ষক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলে ক্যাপস দেশের ৬৪ জেলার জেলা শহরগুলোতে সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের পিএম২.৫ মান পর্যবেক্ষণ করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনার সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার গাজীপুর জেলা। ওই জেলায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অধিক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম২.৫ বার্ষিক গড়ে ঘনমিটারে ছিল ২৬৩.৫১ মাইক্রোগ্রাম। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকায় ছিল ২৫২.৯৩ মাইক্রোগ্রাম। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা নারায়ণগঞ্জে ছিল ২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম। কিছুদিন পূর্বে ঢাকার ধুলাদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করে ক্যাপস বলেছিল, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে।
রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণার কারণেই ঢাকায় দূষণ পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে। গত বছর ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকা ছিল তেজগাঁও। পরের অবস্থানে ছিল শাহবাগ। এছাড়া শহরের প্রত্যেকটি স্থানের বাতাসেই গড় বস্তুকণা ছিল নির্ধারিত মানমাত্রার কয়েকগুণ বেশি।
ক্যাপসের তথ্যমতে, ঢাকা শহরে বিকাল ৪ টার পর থেকে বায়ুদূষণের মান খারাপ হতে থাকে, যা রাত ১১টা থেকে ২টার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে অনেক মালবাহী ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করায় রাতে ব্যাপক বায়ুদূষণ হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরে নির্মূল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। ২০১৬ সালে দূষণ ছিল ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালের ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন এবং ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় সারাবছরই বায়ুদূষণের কবলে ছিল ঢাকা।
দূষণ সম্পর্কে ক্যাপস পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। শিল্পকারখানার দূষণ, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের কাজ, ইটভাটা এবং যানবাহনের দূষণ বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ।
এসব দূষণের কারণে রাজধানী ঢাকায় বাড়ছে নানা রোগে আক্রান্ত রোগী। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলায় সংক্রমণ অথবা ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা যেমন-ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বায়ুদূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্কও দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
আন্তর্জাতিক জার্নাল কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, বায়ুদূষণকে ‘মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমেছে। অকালে মারা যাচ্ছে প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ। গবেষণার প্রধান লেখক জস লেলিয়েভেল্ড বলেন, জনস্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর। ম্যালেরিয়ার তুলনায় ১৯ গুণ এবং এইডসের তুলনায় প্রায় ৯ গুণ বেশি মানুষ বায়ুদূষণের কারণে অকালে মারা যাচ্ছেন। বায়ুদূষণ থেকে কেবল ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৬ শতাংশ মানুষ। এর প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
গবেষকরা বলছেন, ঢাকার এমন বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছেন নগরবাসী। তারা আরো বলছেন, বায়ুদূষণ সরাসরি ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় শ্বসনতন্ত্রের নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধি হয়। বায়ুতে থাকা নানা মাত্রার পার্টিকেল রক্তে মিশে যাওয়ায় ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। আবার লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বায়ুদূষণ মারাত্মক আকারে বাড়লেও দূষণ প্রতিরোধে নেই কার্যকর ব্যবস্থা। ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ বন্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিটে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে কয়েক দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। সেগুলো হলো-বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন হওয়ার পর তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে বায়ুদূষণ বন্ধে ঢাকা শহরের বিভিন্ন নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি/বালি/বর্জ্য ঢেকে রাখা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক রাস্তায় পানি ছিটানো, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি কাজে টেন্ডারের শর্ত পালন নিশ্চিত করা, কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহন জব্দ ও অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করা। এর আগেও রাজধানীতে বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে একাধিকবার হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এবার ক্যাপসও বায়ুদূষণের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি কয়েক দফা সুপারিশ করেছেন। সেগুলো হলো-শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোতে পানি ছিটানো, নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও করা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেওয়া, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা, ফিটনেস বিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা, প্রচুর গাছ লাগানো ও ছাদ বাগান করা এবং নির্মল বায়ু আইন বাস্তবায়ন করা।
গণমাধ্যমে বহু বার এসব নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। আসল বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে কি না। তারা চাইলেই দূষণ রোধ করা সম্ভব।

Exit mobile version