।। ড. সুশান্ত দাস।।
(১)
সভ্যতার এই সময়কালকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ, আরও বিস্তৃত করে বললে বলা যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান একদিনে আজকের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বিজ্ঞানের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পুরোনো বহু ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজ্ঞানকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তার অনেক মর্মান্তিক ইতিহাস রয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে গিয়ে মানুষকে প্রকৃতির রহস্য ভেদ করতে হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক শ্রমের এই নিরন্তর প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মানুষ অর্জন করেছে এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, যা প্রতি মুহূর্তে তার মনন ও চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানের অর্জনের ফলে আজ মানুষ জানতে পেরেছে বস্তু জগত কি দিয়ে তৈরি, কিভাবে তৈরি। এক সময় মনে করা হতো, সব চাইতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা হলো অনু। তারপর দেখা গেল অনুও বিভাজিত হতে পারে, পরমাণুতে। প্রশ্ন এসে গেল, পরমাণু কি দিয়ে তৈরি। তাত্বিক আর ব্যবহারিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দেখা গেল পরমাণুর মধ্যেও কেন্দ্র বা নিউক্লিউয়াস থাকে আর বাইরে ইলেকট্রন নামের ক্ষুদ্র কণা ঘুরে চলে। এখানেই শেষ নয়–কেন্দ্রেও থাকে প্রোটন আর নিউট্রন নামের দু’টি কণা। বিজ্ঞান এগিয়ে চলে । দেখা গেল রহস্য আরও আছে। এই কণাগুলোও আবার ‘কোয়ার্ক’ নামের আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। মানুষ এখন জানে শক্তি আর ভরের সম্পর্ক কি। অর্থাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা জগতেও যে কত বিচিত্র বিস্ময়, বলে শেষ করা যাবে না।
(২)
মানব সভ্যতা এই মুহূর্তে কোভিট–১৯ বা করোনা নামক এক ভাইরাসসৃষ্ট ব্যাধিতে আক্রান্ত। বৈশ্বিক এই প্যানডেমিক মানুষের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সামাজিক জীবন সকল কিছুতেই এক ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানুষকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। হতেই হবে। বিজ্ঞানীরা তাঁদের নিরন্তর চেষ্টায় ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। আরও গবেষণা চলছে। মানুষের মধ্যে যে কোন রোগ সম্পর্কে সাধারণ বৈজ্ঞানিক ধারণা রোগ বিস্তার প্রতিরোধের জন্য অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
যদি এশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এশিয়ার মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু, অনেকক্ষেত্রে ধর্মান্ধও আছেন। এখানে সকল ধর্মের কতকগুলো দৈনন্দিন আচার আচরণ আছে। সেগুলোকে তাঁরা মন থেকে গভীরভাবে জীবনের অংশ হিসেবে নেন। করোনা ভাইরাস সংক্রমন তাঁদের সেই আচার ব্যবহারে আঘাত করলো। তাঁরা বিচিত্র ব্যবহার শুরু করলেন। অনেকে আবার সুযোগ বুঝে তাকে উসকেও দিলেন। এটা আজ পৃথিবীর সকলেরই জানা যে, দক্ষিণ কোরিয়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যে দেশগূলো সফল হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম সারির একটি দেশ। সেখানেও একজন মহিলা গির্জায় যাবার ফলে তিনি ‘superspeader’ বা ‘অতিসংক্রমনকারি’ তে রূপান্তরিত হয়েছেন। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় দ্রুততার সংগে করোনা বিস্তার লাভ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে ( বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) সকল ধর্মের মানুষরাই তাঁদের ধর্মীয় স্থানে ভীড় করেছেন। এখানে সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় আচার পালনে তাঁরা শুধু অভ্যস্ত নন, করণীয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটা তাঁরা তাঁদের জীবনাচরণের অংশ মনে করেন। সেখানে করোনার উপস্থিতি তাঁদের বিশ্বাসের উপর আঘাত দিয়েছে। কিন্তু করোনার বিরুদ্ধে লড়াইএ বিজ্ঞান যখন বলছে, এটা করা যাবে না, এটা বিজ্ঞানসম্মত না, তখন তাঁরা সরাসরি বিজ্ঞানকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। এমনকি ধর্মীয় গ্রন্থে এই ধরণের মহামারিতে যে কাজগুলো করতে বলা হয়েছে, করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেগুলোও তাঁরা স্মরণে আনতে পারছেন না। আগেই বলেছি, অনেকে বিভিন্ন উছিলায় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে, বিজ্ঞানসম্মত কাজটা না করতে। তার ফলাফল কতটা তা বুঝতে সময় লেগেছে, কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
আবার দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্র, ক্ষুধা একটি অন্তরায়। ক্ষিদে থাকলে কোনও জ্ঞানই কাজে দেয়না। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষিদের জ্বালাতেও বৈজ্ঞানিক এই সত্যটাকে মেনে চলতে পারেননি। এই সত্যটাকে বিবেচনা না করে তো তার সামনে সত্যের সবক দিলে তার কাছে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণে একটা বড় সমস্যা হলো আমরা জনগণের আস্থাটাকে গৌণ করে অনেক সময় উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখি। জোর করে চাপিয়ে দিয়ে কোন কাজ করাটাকেই আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণে প্রধান দিক হয়ে ওঠে। তবে এই করোনার দুর্যোগের সময় এর কিছু ব্যতিক্রমও চোখে পড়েছে। এমনকি আমাদের দেশের পুলিশ প্রশাসন সাধারণ মানুষের ভালবাসা বা আস্থা পেয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তা ভালভাবে প্রচারিত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরা প্রচলিত ব্যবহারের গন্ডির বাইরে এসে মানুষের সংগে মানবিক আচরণ করেছেন। (বাইরের দেশে বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া পুলিশ সেই আচরণ করে)। সেনা সদস্যরাও তাই করেছেন। পুলিশ বলতে মানুষের মনে যে বিপরীত চিন্তা কাজ করে তার অনেকটারই ব্যতিক্রম মানুষের চোখে পড়েছে। অনেক জায়গায় পুলিশ সদস্যরা গান করেছেন, বয়স্ক মানুষদের ত্রান নিজে হাতে এগিয়ে দিয়েছেন। রাস্তায় অভাবী নিজের পকেট থেকে মানুষকে টাকা দিয়েছেন, নিজেদের উদ্যোগে ত্রান দিয়েছেন। এগুলো মানুষের মনে দাগ কেটেছে। প্রসঙ্গক্রমে আর একটি বিষয়ে বলা যায়। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি আমাদের সমাজে ইতিবাচক মনোভাব নেই। কেন নেই তার বিশ্লেষণ অন্যত্র হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এটাই সত্য। আগেই বলেছি একে বলে ‘ general perception’ বা সাধারণ ধারণা। এটা সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। কিন্তু, তার অর্থ কি এই যে, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মিদের ছাড়া দেশ চলছে বা চলবে? তাঁরা তো একটি সভ্য সমাজের অপরিহার্য্য ও অতি প্রয়োজনীয় অংশ। হাজার হাজার বছরের চেষ্টায় রোগ ব্যাধি, জরা থেকে বাঁচার জন্য মানুষের নিরলস চেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যতটা পাকাপোক্ত এবং জনমানুষের কাছাকাছি থাকবে ততটাই জীবন সহজ ও সুস্থ হয়ে উঠবে। করোনা মহামারি এটাকে আরো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী তাঁরা পেশাদার ব্যবসায়ী নন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কিউবা ভিয়েতনাম চীনসহ সমাজতন্ত্রমুখী দেশের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। এটা শুধু তাদের ব্যক্তি মানুষগুলোর বিরাটত্ব নয়। বরং যে নীতি বা পদ্ধতি তাদের গড়ে তুলেছে, এটা সেই সমাজব্যবস্থার দান। এটা এখন কিউবার মানুষের জীবনবোধের অংশ। তাই চেতনাকে তাঁরা অনুসরণ করেন, ধারণ করেন অবলীলায়। বোধহয় তাই তা করতেই হবে আগামী সভ্যতাকেও। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাধারণ ধারণা যতটা সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিস্কারভাবে যাবে, বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষের বাস্তব প্রয়োজনটাও দৃশ্যমানভাবে মেটানো যাবে, বিজ্ঞানকে দূরের বস্তু নয়, জীবনাচরণের অংশ হিসেবে প্রস্তুত করা যাবে, মানুষ ততটাই বিজ্ঞানকে ধারণ করে যে কোন অশুভ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করাতে পারবে শক্তভাবে।
মানুষ, মানুষ এবং মানুষই সভ্যতার শেষ কথা। মানুষ যতটা বিজ্ঞানমনস্ক হবে, ততটাই মানুষ তার জীবন, বিশ্বাস ও সামাজিক আচরণে যুক্তিসিদ্ধ হয়ে উঠবে। মানুষ ততটাই পারিপার্শ্বিক প্রকৃতিকে ও পরিবেশকে রক্ষা করবে। তাই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মনস্কতাকে যেমন ভিত্তি করতে হবে তেমনি বিজ্ঞানমনস্কতাকেও ধৈর্যধরে মানুষের চিরাচরিত বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। একটানে বিজ্ঞানকে তার বিপরীতে ও বিরুদ্ধে দাঁড় করালে বিজ্ঞানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষও তাকে গ্রহণ করতে চাইবে না। এটা মনে রাখতে হবে, মানুষ যখন বিজ্ঞানকে নিজস্ব চেতনা দিয়ে গ্রহণ করে, তখন বিজ্ঞানও সমৃদ্ধ হয়, মানুষও সমৃদ্ধ হয়। তখন সভ্যতা এগিয়ে চলে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি