।। অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি ।।
আর্যরাই ভারতীয় সভ্যতার গুরু। বাকিরা বহিরাগত। ভারতীয় সংস্কৃতির মূল হচ্ছে বেদ। বেদজ্ঞ যারা তারাই সর্বজ্ঞ! ভারতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে অনার্যসহ মুসলিম-ইউরোপীয়রা। তারাই নাকি অভারতীয়। তারা অহিন্দু- বহিরাগত। নারায়ণ রূপি বেদজ্ঞ গুরুদের স্পষ্ট বয়ান, “বিধর্মী এবং বহিরাগতদের তাড়িয়ে ভারতবর্ষে ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শপথ নিতে হবে। তাদের নানামুখী তোরজোড়ে ” ভারতের বৈচিত্র্যময়” সংস্কৃতির ঐক্যে ফাটল ধরেছে। বিভেদের আগুন ছড়িয়েছে চারদিকে। বিপন্ন নানা রং-এর ফুলে গাঁথা যুক্ত বেণির গৌরবময় সংস্কৃতি। বেদজ্ঞরা করোনা নিয়েও সবসময় হাসি তামাশায় মেতে উঠেছিলেন। ভাবখানা এমন ছিল, বেদজ্ঞ শাসিত রাষ্ট্রে প্রজারা করোনায় কাবু হবে না। কারণ রাজা অবতার। নারায়ণ রূপে রাজা সিংহাসনে বসে আছেন। তাই ” জয়শ্রী রাম” মনেই করে করোনা হটে যাবে-এই ভাবনাকেই জনগণের মধ্যে উসকে দেওয়া হয়েছিল। শুরুতেই, ভারতের অনেক রাজ্যে করোনার মহাওষুধ হিসেবে গো-মুত্র বোতলজাত করে বিক্রির হিড়িকও পড়েছিল। কিন্তু আজ করোনা মহামারিতে ভারতের অবস্থ খুবই নাজুক। ভারতের সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষ করোনায় হাঁসফাঁস করছেন। প্রতিদিন তিন লাখের উপর মানুষ করোনায় আক্রান্ত। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। অক্সিজেন, বেড, হাসপাতাল সংকট চরমে। মৃতদেহ সৎকারে শ্মশান ও কবরের জায়গা মিলছে না। ভয়াবহ সংকট ভারতের নানা রাজ্যে। গণচিতায় লাশ পোড়নো হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে গণকবর! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এবারের ভারতীয় করোনার ভ্যারিয়েন্ট নাকী খুবই শক্তিশালী। দ্রু রূপ পাল্টাতে পারে এবং খুবই ছোঁয়াচে। তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের অবস্থা কী হবে। এদেশের চারদিকে তো ভারত সীমান্ত। প্রতিদিন লাখো মানুষ চিকিৎসা গ্রহণসহ নানা কাজে ভারতে যাতায়াত করেন। ওই মানুষগুলো আমাদের শত্রু না। শত্রু ভারতীয় রূপের করোনা। ওই করোনা ভাইরাস ঠেকাতে সীমান্তের সব পয়েন্ট রেডএলার্ড জারি করতে হবে। সব পথেই। এটা করা না গেলে তৃতীয় ঢেউ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। অবশ্য সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কলকাতা টিভিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বলেছেন, “করোনা মোকাবেলায় ডাক্তারের পরামর্শ মানতে হবে।” প্রশ্ন-অন্ধবিশ্বাস, কুপম-কতা ও কুসংস্কার ছড়িয়ে মানুষের মাঝে যে ভাবাদর্শের আনুগত্য তৈরি করা হল তার বিনাশ হবে কী ভাবে! (?)। পাল্টা একই অবস্থান দেখছি আামাদের বাংলাদেশেও। করোনাভাইরাস নিয়ে এদেশে নানা বয়ান দিয়েছে কাঠ মোল্লার দল। ইউটিউব সার্চ করলেই তা মিলবে। বলা হয়েছে, “করোনা রোগে আক্রান্ত হবে ইহুদী, কাফের, বিধর্মী’রা। ঈমানদার মুমিন মুসলমান’রা এ রোগে আক্রান্ত হবেন না। মাস্ক পড়ার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ্ ভরসা-ইত্যাদি নানা বয়ান দিয়ে এরাও বেদজ্ঞের বিপরীতে ওহাবী- মুওদুদী-হেফাজতি মতবাদে সর্বজ্ঞ হতে চেয়েছিলেন। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এরাও বেদজ্ঞের মতো “বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা” দখলে ছিলেন মরিয়া। এখনো তারা নানাভাবে তৎপর। ফলে দেশ আলাদা হলেও লক্ষ্য অভিন্ন। উভয় দেশেই তথাকথিত ধর্মীয় সর্বজ্ঞদের আক্রমণের লক্ষবস্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-নানা জাতের মানুষ। মার্কিনমুলুকেও চলছে একই খেলা-রূপ একটু আলাদা! করোনাকালে মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসছেন। মানবতার ধর্ম নিয়ে মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। গুজরাট, দিল্লী, পশ্চিমবঙ্গসহ নানা রাজ্যে এবং আমাদের বাংলাদেশের নানা জেলা ও অঞ্চলে দেখছি করোনা আক্রান্ত মানুষের সেবায়, মানবকল্যাণে মানুষের নানামুখী কর্মযজ্ঞ। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশকে থাকতে হবে সজাগ, সতর্ক ও স্বাস্থ্য সচেতন। ভারত থেকে যারা ফেরত আসবেন তাদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারাইন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। নিজস্ব টিকা উৎপাদনে এখন দরকার জরুরি মনোযোগ। সময় অনেক নষ্ট করেছি, আর না। শেষ কথা, মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারকে করতে হবে পরাভূত। প্রসার ঘটাতে হবে যুক্তিবাদী চিন্তা ও বিজ্ঞান মনষ্কতা। বিকাশ ঘটাতে হবে বাংলার সংস্কৃতির ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় উপাদান ধর্ম। আমরা এ মাটিতে ধর্ম গ্রহন করেছি আমাদের মতো করে। আমাদের রক্তে অজ¯্র রক্তধারার মিশ্রণ ঘটেছে যুগে যুগে। নানা জাতির রক্ত ভালবাসার মতো মিশেছে আমাদের শরীরে। আমাদের ধর্ম, মানুষের ধর্ম। মানবতার ধর্ম। আমাদের ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য এখানেই। সুফিবাদের সাম্য ও মানবিকতায় প্রভাবিত হয়েছিল চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম। চৈতন্যদেব বেদজ্ঞ সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্কার এনেছিলেন সুফিবাদকেঅনুসরণ করেই। ওই সময়কালের কবি চন্ডিদাস মানবতার শ্বাশত বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, “শোন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।
লেখকঃ পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।