।। সৈয়দ আমিরুজ্জামান ।।
মুক্তচিন্তার লেখক ও যুক্তিবাদী দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
বিদ্যা মানুষকে পথ দেখায়। সে পথ হচ্ছে মুক্তির। সেটা অর্জন করা যায় দুইভাবে যথা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা মানুষকে পথ দেখালেও ক’জন প্রকৃত মানুষ বা শিক্ষিত হতে পেরেছেন? হয়তো হাতে গোনা ক’জন। আবার কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতিরেকেই স্বশিক্ষিত হয়ে উন্মোচন করেছেন জীবন ও জগতের গুঢ় রহস্য। এমনই এক মহান স্বশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, মুক্তচিন্তার লেখক ও যুক্তিবাদী দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর।
আরজ আলী মাতুব্বর ১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখে বরিশাল জেলার লামচরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের চার বছর পর ১৯০৪ সালে তাঁর পিতা এন্তাজ আলী মাতুব্বর মারা যান। মৃত্যুকালে আরজ আলী মাতুব্বর উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যান পাঁচ বিঘা জমি আর দুটি টিনের ঘর। আরজ আলীরা ছিলেন তিন ভাই ও দুই বোন। দুই ভাই কাছেম আলী ও ছোমেদ আলী মারা যায় ১৮৯৪ সালে। ১৯১০ সালে আরজ আলী মাতুব্বরের মা জমির খাজনা দিতে না পারলে যে সামান্য জমিটুকু ছিলো তা জমিদাররা নিলামে চড়িয়ে নিজেরা দখল করে নেয়। বেঁচে থাকার জন্য আরজ আলী মাতুব্বরের মা সেই সময়ে বরিশালের কুখ্যাত সুদের কারবারি জনার্দন সেনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করেন। এই দেনার দায়ে ১৯১১ সালে জনার্দন সেন আরজ আলী মাতুব্বরদের টিনের বসত বাড়ি নিলাম করে নেয়, অভদ্র সুদের কারবারি হলেও কিন্তু ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করেননি।
আরজ আলী মাতুব্বরের যখন তেরো বছর বয়স তখন লামচরি গ্রামের আবদুল করিম মুন্সী নামে একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে একটি মক্তব খুলে বসেন। আরজ আলী মাতুব্বরের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ দেখে এবং এতিম ছেলে বলে তাঁকে মুন্সী সাহেব বিনা বেতনে মক্তবে ভর্তি করে নেন। পড়াশুনায় প্রবল আগ্রহ দেখে আরজের এক জ্ঞাতি চাচা সীতারাম বসাক লিখিত আদর্শলিপি বই কিনে দেন। ছাত্রদের বেতন অনাদায়ে মক্তবের অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে সেই বছরই বন্ধ হয়ে যায় মক্তবটি। মুন্সী আবদুল করিমের মক্তব বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়া আরজ আলী মাতুব্বরের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। পাঠ্যশিক্ষা আরও কিছুটা এগিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে আরজ আলী মাতুব্বর বরিশাল শহরের পরিচিত ছাত্রদের পুরনো বইপত্র সংগ্রহ করে পড়তে থাকেন। বরিশাল শহরেই ছিলো একটি পাবলিক লাইব্রেরি। আরজ আলী মাতুব্বর এই লাইব্রেরিতে নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলেন। লামচরি গ্রাম থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে তিনি প্রতিদিন লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করতেন।
বরিশালে আরেকটি লাইব্রেরির নাম ছিলো শঙ্কর লাইব্রেরি, এই লাইব্রেরি থেকেই টানা তিন বছর তিনি বই নিয়ে পড়েছেন। সে সময় খ্রিস্টান মিশনারীদের একটি লাইব্রেরি ছিলো, নাম ‘ব্যাপটিস্ট মিশন লাইব্রেরি’; এই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান ছিলেন স্কটল্যান্ডবাসী মিস্টার মরিস। জ্ঞান পিপাসা মেটাবার জন্য মরিস সাহেব ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৫ এই ছয় বছর আরজ আলী মাতুব্বরকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ লাইব্রেরি থেকেও বই নিয়ে পড়াশুনা করেছেন আরজ আলী মাতুব্বর, তাঁকে এখানে বই লেনদেনে সহায়তা করেন কলেজের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির।
১৯২৩ সাল থেকে আরজ আলী মাতুব্বর ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। আঠারো বছর বই কিনে তা সংগ্রহের ফলে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় নয়শত। বই গুছিয়ে যত্নে রাখার জন্য আলমারি কেনার সামর্থ না হওয়ায় বৈঠকখানার তাকে বইগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৪১ সালের এপ্রিলে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আরজ আলী মাতুব্বরের বৈঠকখানা এবং সেই সঙ্গে বৈঠকখানায় রাখা সবগুলো বই উড়িয়ে নিয়ে যায়, একটি বইও অক্ষত উদ্ধার করতে পারেননি তিনি। জীবনের এক মর্মান্তিক বাস্তবতার পরম অভিজ্ঞতা বলে মনকে প্রবোধ দিয়ে পুনরায় তিনি বই সংগ্রহ করতে থাকেন। নিরলস হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বই কিনে সতের বছরের ব্যবধানে তাঁর বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় চারশত। ঠিক সেই সময় ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আরেক দফা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় একই বৈঠকখানার একইভাবে সংগৃহীত বইগুলো। এরপর দীর্ঘ একুশ বছর কঠিন শ্রমে ক্রমে ক্রমে সঞ্চিত অর্থে শুধুমাত্র বই রাখার জন্যই মজবুত দালান ঘর নির্মাণ করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে এই দালান ঘরেই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’।
১৯১৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেলে কিছুকাল ঘোরাফেরা করে ১৯১৯ সালে নিয়োজিত হন পৈতৃক পেশা কৃষি কাজে। কৃষি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি মাপজোকের আমিনের কাজও শিখে ফেলেন, পরবর্তীকালে ১৯২৫ সালে তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি আমিনী পেশা শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী নূরুল ইসলামের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ক্লাস নিয়েছেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষার্থীরা তাঁর লেকচার শুনেছিলেন; শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছিলেন অকপটে। আরজ আলী মাতুব্বর একসময় আবিস্কারের নেশায় আবিস্কার করে বসেন জলঘড়ি ও বৈদ্যুতিক পাখা, বিজ্ঞান চেতনায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন তিনি। বই পড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ এমন ছিলো যে, তিনি লাঙল ঠেলতে ঠেলতে বই পড়তেন। কারো সঙ্গে পথ চললে তিনি আগে যেতেন না, কারণ হিসেবে তিনি বলতেন-কারো পিছনে হাঁটলে চিন্তা করার সুযোগ পান।
১৯৩২ সালে আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে, যার মাধ্যমে তাঁর চেতনার উন্মেষ ঘটে, বোধ বিকশিত হবার সুযোগ পায়; জ্ঞানলোকের পথ উন্মুক্ত হয়, মনের ভেজানো অর্গল যায় খুলে। বলা যায়, একটি মাত্র ঘটনাই আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৩২ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যু ঘটলে তিনি জীবনের সবচেয়ে আপনজনের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তাঁর মৃত মায়ের ছবি তুলে রাখতে চাইলেন। গ্রামের লোক তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস অনুযায়ী এই ছবি তোলার প্রতিবাদস্বরূপ তাঁর মায়ের জানাজা বর্জন করে, এই সময় আরজ আলী মাতুব্বর সুহৃদ কয়েকজনকে নিয়ে জানাজা সম্পন্ন করেন। আরজ আলী মাতুব্বরের অনুভূতিপ্রবণ মনে এই ঘটনা নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তাঁর মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হয়। এই ঘটনার পর থেকে আরজ আলী মাতুব্বরের বোধের যে উন্মোচন ঘটে, তা ক্রমশ সুসংহত হতে থাকে এবং মুক্তবুদ্ধিচর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে ১৯৬০ সালে ৬০ বছর বয়সে আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সমান ভাগে বণ্টন করে দেন। তবে একই সময়ে তিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদের জানিয়ে দেন, এরপর থেকে মৃত্যু অবধি সময়ের মধ্যে উপার্জিত অর্থ তিনি জনকল্যাণে ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করেন; এতে তাঁর সন্তানদের কোনো দাবি থাকবে না। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তাঁর সঞ্চিত ও ক্রয়কৃত জমির মূল্য দাঁড়ায় ৬০ হাজার টাকা, জমি বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে সব মিলিয়ে মোট চারশটি বই নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি অপার স্নেহ ও ভালোবাসা থেকেই তিনি বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন, এই বৃত্তি প্রদান শুরু হয় ১৯৬১ সাল থেকে, বৃত্তি প্রদানের জন্য গঠিত ‘আরজ ফান্ড’ থেকে দেওয়া বৃত্তি তিনটির নাম রাখা হয় ‘আরজ বৃত্তি’। ১৯৮১ সালে আরজ আলী মাতুব্বর সুস্থ শরীরে, সেচ্ছায়, সজ্ঞানে তাঁর মৃতদেহটি বরিশাল মেডিকেল কলেজকে দান করে যান চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধনের জন্য।
আরজ আলী মাতুব্বর অসীম নিষ্ঠা ও পাণ্ডিত্যের সাথে ৩০ বছরেরও অধিক সময়কালে এগারোটি পাণ্ডুলিপি রচনা করে গেছেন। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি বই এবং একটি সংকলন-সত্যের সন্ধান, অনুমান, সৃষ্টি রহস্য ও স্মরণিকা; তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ঢাকার পাঠক সমাবেশ প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছে আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা সমগ্র। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই বইগুলো ছাড়াও তাঁর মৃত্যুর পর ছয়টি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে—’সীজের ফুল’ (কবিতা), ‘জীবন বাণী’ (আত্মজীবনী), ‘ভিখারীর আত্মকাহিনী’ (আত্মজীবনী), ‘কৃষকের ভাগ্যগ্রহ’ (প্রবন্ধ) এবং ‘বেদের অবদান’ (প্রবন্ধ)। আরজ আলী মাতুব্বর রচিত প্রথম বই ‘সত্যের সন্ধান’, এই পাণ্ডুলিপিটি লেখা শেষ হয় ১৯৫১ সালে, প্রকাশিত হয় রচনার ২৬ বছর পরে ১৯৭৭ সালে; এই বইয়ের মূল বিষয় ছয়টি, প্রথমে এই বইটির নামকরণ করা হয়েছিলো-‘যুক্তিবাদ’।
আরজ আলী মাতুব্বর প্রচলিত ধর্মীয় আচারের প্রতি অনীহা থাকা সত্ত্বেও ধর্মপ্রাণ স্ত্রীর (সুফিয়া খাতুন) ধর্মীয় কার্যকলাপে কখনও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াননি। চরমোনাই মাদ্রাসার মাওলানা ইউসুফ ১৯৮০ সালের এপ্রিলের ১৯ তারিখে বরিশাল আল আমিন প্রেসের কর্তৃপক্ষকে সত্যের সন্ধান বইটি ছাপতে বাধা দেন, একই মাসের ২১ তারিখে আলোচ্য মাওলানা সাহেবের ইঙ্গিতে ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্র শিবির) কতিপয় যুবক বরিশাল আল আমিন প্রেসে ঢুকে ‘সত্যের সন্ধান’ ছাপতে বাধা দেয় এবং ওই বইয়ের ছাপানো কুড়ি নম্বর ফর্মার একটি কপি জোড়পূর্বক নিয়ে যায়। ইসলামী ছাত্র সংঘের কতিপয় যুবক বরিশাল কলেজ রোডে বলপূর্বক মাতুব্বর সাহেবকে কোনো অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে এবং তাঁর পকেট থেকে এক থেকে কুড়ি ফর্মার এক কপি ‘সত্যের সন্ধান’ জোড়পূর্বক ছিনিয়ে নেয়। এক থেকে কুড়ি ফর্মা বরিশাল আল আমিন প্রেসে এবং অবশিষ্ট একুশ থেকে বাইশ ফর্মা ঢাকার বর্ণ মিছিল প্রেসে ছাপা হয়।
বিশ্বভারতীর উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্য তাঁকে ডি.লিট দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য এই সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজনের পূর্বেই মারা যান কালিদাস ভট্টাচার্য। আরজ আলী মাতুব্বর সম্মাননা পেয়েছিলেন কাজের তুলনায় খুবই অল্প। বাংলা একাডেমি ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করেন এবং ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে প্রদান করে ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’। ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ ছিয়াশি বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন বাঙলার এই মহান জ্ঞানসাধক।
আরজ আলী মাতুব্বর এই পোড়ার দেশের ভাটি অঞ্চলে একশত পনেরো বছর পূর্বে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দেশেরই অন্ধকারের আলোর দিশারী আরজ আলী মাতুব্বর। মায়ের মৃত্যু ও নানাবিদ স্পর্শকাতর ঘটনা আরজ আলী মাতুব্বরকে সত্যসন্ধানী হতে সহযোগিতা করে। আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মস্থান ভাটি অঞ্চল বরিশাল আজও কুসংস্কারের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত। সেই সময়ের অন্ধকারের মানুষদের আলোকিত করার মানসে আরজ আলী মাতুব্বর নিরলস সাধনা করে গেছেন, রচনা করেছেন অমূল্য কিছু গ্রন্থ। অথচ আমরা আজও আরজ আলী মাতুব্বরকে দিতে পারিনি একুশে পদক কিংবা বাংলা একাডেমি পদক; রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না পেলেও আরজ আলী মাতুব্বর স্থান করে নিয়েছেন প্রতিটি মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন বাঙালির হৃদয়ে।
প্রয়াত একাডেমিক দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন—’মানবতাকেই আমি একটা ধর্ম মনে করি। মানবতাই একটা ধর্ম। আমি এটা পালন করি এবং অন্যকে পালন করতে পরামর্শ দেই।’ —তিনি ধর্মকে কেবল বিশ্বাসের রূপক হিসেবে দেখেননি, তিনি যুক্তি-তর্কের সাহায্যে ধর্মকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। আদিম কাল থেকে সাধারণ মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে যে জ্ঞানজিজ্ঞাসা লালন করে, তিনি সেই জ্ঞানজিজ্ঞাসা যুক্তিসঙ্গতভাবে তুলে ধরেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরকে বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান ‘ধীমান কৃষক’ হিসেবে দেখেছেন, অন্যদিকে তিনি তাঁকে ‘দার্শনিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শামসুর রাহমান বলেছেন— ‘আরজ আলী মাতুব্বর একজন দার্শনিক ছিলেন এমন একটি বাক্য উচ্চারণ করতে আমার ভালো লাগে।’
শামসুর রাহমানের ভাষায় আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন দর্শনের রূপকার।
হাসান আজিজুল হক লিখেছেন— “আরজ আলী মাতুব্বর এদিক থেকে কী মধ্যবিত্ত, কী জনসাধারণ দুই হিসেবেই এদেশের প্রথম বাংলা ভাষা-ভাষী খাঁটি দার্শনিক এবং একই সঙ্গে ‘নলেজ’ ও ‘উইজডম’-এর অধিকারী। লেখাপড়া বেশি করলে ‘নলেজ’-এর পরিমাণ বেশি হয়ে যেত। যদি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, কান্ট, হেগেল বেশি পড়তেন তবে ওঁদেরকে স্বীকার-অস্বীকার করা বা ওঁদের আশে-পাশে ঘোরা-ফেরা ছাড়া বেশি কিছু করতে পারতেন না। পা দুটো যে মাটিতে গাঁথা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনভাবনা ভেবেছেন। …আধুুনিক জীবন, আধুনিক সংস্কৃতি দ্বারা তাঁকে আক্রান্ত হতে হয়নি। স্বয়ম্ভু এক বৃক্ষের মতোই আস্তে আস্তে তাঁর তৈরি হওয়া।”
বাট্রার্ন্ড রাসেল খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, জাঁ-পল সার্ত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা নিজ দেশে অনেক সম্মান পেয়েছেন। দার্শনিক নিটশে বলেছেন, ‘ঈশ্বর মৃত’। কিন্তু নিটশে পড়ানো হয় পৃথিবীর সব দেশে।
আরজ আলী মাতুব্বরকে একজন বিজ্ঞানী ও লৌকিক দার্শনিক অভিধায় ভূষিত করা হয়, তাঁর লেখা হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাবাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একদিকে বলা যায় তিনি যুক্তিবাদী দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী, আবার অন্যদিকে বলা যায় তিনি আধুনিক চার্বাকবাদী।
আরজ আলী মাতুব্বরের মতো আরও স্বাধীনচেতা মানুষ এদেশে প্রায়শই দেখা যায়। করম শাহ ১৭৭৫ সালে ময়মনসিংহের সুষঙ্গ দুর্গাপুর ও শেরপুর পরগণার আদিবাসী ও কৃষকদের মধ্যে ‘পাগলপন্থা’র প্রচার করেন, কৃষকেরা এতে প্রবলভাবে সাড়া দিয়ে ‘পাগলপন্থা’র সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ১৮১৩ সালে করম শাহের মৃত্যু হলে তাঁর শিষ্য টিপু পাগলা পাগলপন্থিদের নেতা নির্বাচিত হন, টিপু পাগলার নেতৃত্বে কৃষকেরা জমিদারকে খাজনা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়; তারপর শেরপুরের জমিদারকে ১৮২৫ সালে উৎখাত করে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। এই রাজ্যের কোনো কৃষক কাউকে আর কোনো দিন খাজনা দিতো না, জমির ওপর সহজ ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো সব কৃষক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই লিখেছেন- ‘এমন অবস্থায় হয় ধর্মশাস্ত্রকে নিজের ভ্রান্তি কবুল করিতে হয়, নয় বিদ্রোহী বিদ্যা সাতন্ত্র অবলম্বন করে; উভয়ের এক অন্নে থাকা আর সম্ভবপর হয় না।’
তাই বিবর্তনবাদ থেকে বস্তুবাদী দর্শনের মতো নানা বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ এবং পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের কারণে ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মের ভিত্তি কেঁপে ওঠে। আদিম ও প্রাচীনকালের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসে। যখন ম্যাজিক ও ধর্মশাসন উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো। দলে দলে মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাস ও ধর্ম পরিচয় থেকে মুক্ত বলে নিজেদের ঘোষণা করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে ধর্মবিশ্বাসের পৌনঃপুনিক বিভ্রান্তির মায়াজাল থেকে মুক্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ষোলো জন বা সাতাশি কোটি বাষট্টি লক্ষ জন। [সূত্র: Encyclopedia Britannica, 1993 Book of the year) ধর্মের উৎস সন্ধানে, ভবানী প্রসাদ সাহু]
নতুন শতকের দ্রোহ ও নির্মাণের আশাবাদ নিয়ে আমরা সত্যসাধক, লৌকিক দার্শনিক ও লেখক আরজ আলী মাতুব্বরের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি-‘অধুনা বস্তুবাদের সাথে ত্যাগ ও প্রেমযোগে মানব জগতে গড়িয়া উঠিয়াছে একটা নতুন মতবাদ, যাহার নাম মানবতাবাদ। ইহা বৈজ্ঞানিক সমাজ সমাদৃত, অনেকটা বাহিরেও। বিজ্ঞানের দুর্বার অগ্রগতি দেখিয়া মনে হয় যে-একদা মানবজগতের আন্তর্জাতিক ধর্মই হইবে মানবতাবাদ (Humanism)।’
আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ, উপমহাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদীদের উত্থানপর্বের বৈরী সময়ে আরজ আলী মাতুব্বর অসাম্প্রদায়িক চেতনার নায়ক; তাঁকে যথাযথ সম্মানে ভূষিত করার দায়িত্ব সচেতন মহলের। তিনি মানবতার কল্যাণে নিজের দুটি চোখ এবং জ্ঞানচক্ষু দান করে গেছেন। তিনি যে জ্ঞানালোক ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই মহৎ কাজটি করতে পারলেই তাঁকে প্রকৃত সম্মান জানানো হবে; সম্ভব হবে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মুক্ত নতুন সমাজ নির্মাণ।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।