বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির
৫০ বছর পূর্তিতে ওয়ার্কার্স পার্টির ওয়েবিনারে বক্তারা
“বর্তমানে দেশকে যে ধারায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠিত বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে এবং জনগণের মালিকানার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান রক্ষার সংগ্রামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।” -সভাপতির ভাষণে বললেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। আর মূলপত্র উপস্থাপনে পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উৎসবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমধারা ও বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বদানের বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপিত হলেও ওই লড়াইয়ে বামপন্থীদের ভূমিকার কথা কেবল অনুল্লেখিতই নয়, অস্বীকৃতও বটে। তবে ইতিহাস কোনোদিন মুছে ফেলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকাও মুছে ফেলা যাবে না। আজ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ৫০ বছর এবং উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান” শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তারা এসব কথা বলেন। ১৯৭১-এর ২ রা জুন ভারতের কলকাতায় এদেশের বামপন্থীদের সমন্বয়ে মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে গঠিত“ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’-৫০ বছর উপলক্ষ্যে ওই ওয়েবিনারের আয়োজক ছিল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
মূলপত্র উপস্থাপনের সময় কমরেড রাশেদ খান মেনন আরো বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ’৭১-এর ২রা জুন ছিল একটি অনবদ্য দিন। এদিন এদেশের বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধকালে বামমহলে যে বিভ্রান্তি ছিল তা কাটিয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিলেন। তিনি বলেন, এই কমিটি একদিকে যেমন প্রবাসী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন করেছিল, তেমনি ভারতের মাটিতে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত বাধা পেরিয়ে ১৪ টি স্থানে নিজস্ব লড়াই পরিচালনা এবং মুক্তাঞ্চল গঠন করেছিল।
মেনন বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয়তাবাদী ক্রমধারা উল্লেখ করা হলেও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এবং তার প্রাক পর্বে বামপন্থীদের বলিষ্ঠ এবং অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকাকে কেবল অনুল্লেখ করাই হচ্ছে না, অস্বীকারও করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস কথা বলবে। মুক্তিযুদ্ধে এবং তার প্রাক-পর্বে বামপন্থীদের ভূমিকাকে যতই অস্বীকার করা হোক, এক সময় দেশবাসী তা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। এটা অমোঘ সত্য।
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সংকেত উল্লেখ করে রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি পরাস্থ হলেও তার বিপদ কাটে নি। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহ’ এবং মূলনীতিতে ‘আল্লাহর ওপর অকৃত্রিম বিশ্বাস’ যুক্ত করে সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলো। এটাকে আরো বৃহত্তর রূপ দিয়ে সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম যুক্ত করে এরশাদ পরিপূর্ণভাবে কেবল ইসলামিপ্রজাতন্ত্র বাদে বাংলাদেশকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে। গোলাম আযমকে নাগরিত্ব দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানকে আরো পাকাপোক্ত করে খালেদা জিয়া। বর্তমান সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ করলো না। বরং সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে আপোস করা হলো। ফলে মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে কোনঠাসা জামাতের বেনামে হেফাজতের আস্ফালন ও তাণ্ডব দেখলাম।
তিনি বলেন, এ বিপদ কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিপদ উপমহাদেশেও সমভাবে বিদ্যমান। পাকিস্তানে ইমরানের সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন দিয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করছে। বাড়ছে ইসলামি জঙ্গিবাদের বিপদ। আর ভারতে হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে বাড়ছে হিন্দু মৌলবাদী বিপদ। তাই উপমহাদেশের বামপন্থীদের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে মওলানা ভাসানীর অবদান ছিল অনন্য। তিনি মাংসেতুংকে চিঠিতে বলেছিলেন,“ চীনের অস্ত্র দিয়ে যদি বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করা হয়, তাহলে সেই দেশকে কী করে সমাজতান্ত্রিক বলা যায়?”।
কমরেড বাদশা বলেন, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন ও জনগণের মুক্তির জন্য লড়াই করেছি। কিন্তু দেখছি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বিপদ বাড়ছে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখতে আওয়ামী লীগের কর্মকা-ও প্রশ্নবিদ্ধ। ওয়ার্কার্স পার্টি এক্ষেত্রে আপোসহীন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এদেশের সংবিধান রক্ষায় ওয়ার্কার্স পার্টি তার লড়াইয়ে পিছুপা হবে না।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের এই নীতিতে আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। আমি তরুণ প্রজন্ম ও পার্টি কর্মীদের বলবো, ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে মানুষের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হউন। করোনা মোকাবেলায় শারীরিক দূরুত্ব বজায় রাখুন। তবে সামাজিক দূরুত্ব নয়, সামাজিক সংহতি গড়ে তুলুন।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড মহম্মদ সেলিম বলেন, সাম্প্রদায়িক বিপদ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি। সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে আধিপত্য বিস্তার ও লুণ্ঠন ও নিজেদের ফায়দা লুটতে ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে ঠেলে দিয়ে তারা তাদের লুটপাটের ধারা অব্যাহত রাখতে মানুষকে সেই চিন্তা থেকে দূরে রাখে। তাই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখতে জনগণের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে তাদের পাশে থেকে সাম্প্রদায়িক বিপদ থেকে মুক্ত হতে হবে।
সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় সদস্য কমরেড গৌতম দাস বলেন, সাম্প্রদায়িক উত্থানের পিছনে বড় ভূমিকা পালন করছে নয়া উদারাবাদ ও ভোগবাদী দর্শন। নতুন প্রজন্মকে এর খপ্পড় থেকে বের করে আনতে হবে। তা না হলে সাম্প্রদায়িক বিপদ রুখা যাবে না।
পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড আলী আহমদ এনামূল হক ইমরানের সঞ্চালনায় আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য শামসুল হুদা।