বিজয়ের ৫০ বছর
॥ এম এইচ নাহিদ ॥
চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বাঙালির ইতিহাসে এটি অবিস্মরণীয় মাস। ’৭১-এর এ মাসের ১৬-তে রক্তস্নাত বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন এ জাতি। সেই বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তা দ্বিধাহীনভাবে স্পষ্ট। কিন্তু এদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষ সে স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন। একই সাথে স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধকালে এদেশের বামপন্থীরা কেবল অনন্য ভূমিকাই নয়, অনেকাংশে অগ্রগামী ভূমিকাও রেখেছিলেন। তার পরেও গণমাধ্যমে সে কথা বেশি আসে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বামপন্থীদের ভূমিকা আঁড়াল হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে স্বাধীনতার ক্রমধারা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বদানের বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হলেও বামপন্থীদের ভূমিকা উল্লেখ তো করা হয়’ই নি, বরং তা অস্বীকৃত’ই থেকেছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবেও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে! কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা যতোই খাটো করে দেখা হোক, ইতিহাস তা একদিন মূল্যায়ন করবেই।
মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে সেই ৫০-এর দশকেই মওলানা ভাষানী পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন। ৬০-এর দশকে বামপন্থীদের প্রথম সাহসী উচ্চারণ-“পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ব বাংলা”। অনেক আগেই পূর্ব বাংলার ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক সহ সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয়া এবং মুক্তির সংগ্রামে প্রস্তুত করার কাজটি করেছিলেন এদেশের বামপন্থীরা। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ৬০-এর দশকের লড়াই-সংগ্রাম’ই পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলার মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে রূপ নিয়েছিল। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের আগেই বামপন্থীরা গ্রামগঞ্জে ঘেরাও আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়াজ তুলেছিল,“শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব-বাংলা স্বাধীন কর।” অন্যদিকে ’৬৯-এর গণআন্দোলন যে উত্তাল গণঅভ্যূত্থানে রূপ নিয়েছিল তার মূলে যার আত্মদান ছিল, সেই শহীদ আসাদও ছিলেন বামপন্থী নেতা।
কেবল তাই নয়, ’৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে এদেশের স্বাধীনতার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিল বামপন্থীরা। সেদিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ও বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের ঘোষণায় ১১ দফা উত্থাপন করায় পাকিস্তানি সামরিক আদালত ওই ঘোষণার নায়ক রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফরকে ৭ বছর সশ্রম কারাদ- দিয়েছিলেন এবং তাদের সম্পত্তির ৬০ ভাগ বায়েজাপ্ত করেছিল। এক বছর করে সাজা দিয়েছিল মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহাবুবুল্লাহকে। তাতে দমে যায় নি বামপন্থীরা। বরং আরো সাহসী ভূমিকা নিয়ে ’৭১-এর ২ জুন ভারতের কলকাতায় মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে গঠন করে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’। ওই কমিটি প্রবাসী সরকারকে যেমন অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল, তেমনি দেশের অভ্যন্তরে বামপন্থীদের নিজস্ব লড়াইও পরিচালনা করেছে।
‘দুই কুকুরের লড়াই’-তত্ত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধে কতিপয় বামপন্থীদের বির্তকিত ভূমিকা থাকলেও সামগ্রীকভাবে মুক্তির সংগ্রামে বামপন্থীদের অগ্রগামী ও অনন্য ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি ঘাঁটি এলাকা করে সেগুলোতে বিজয়ের অনেক আগেই মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলে। নরসিংদীর শিবপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় কার্যত নতুন ইতিহাস তৈরি করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে উপরে যে জায়গাগুলি স্থান পেতে পারে তার অন্যতম শিবপুর। শিবপুরের নেতা ছিলেন মান্নান ভুঁইয়া। এই মুক্তাঞ্চলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। এখানকার কোনো অস্ত্র ভারত থেকে আসে নি। কমিউনিস্টরা পাকবাহিনীর থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিলেন এবং ইপিআর ও সেনার পরিত্যক্ত অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। শিবপুরে এক ধরনের জনপ্রিয় গণপ্রশাসন তৈরি হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। শিবপুরের গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের প্রায় পুরো সময়টাই মুক্ত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নেরও ভূমিকা রয়েছে। তারা ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের ভিতরে লড়াই করতে পাঠায়। কুমিল্লার বেতিয়ারায় ঐতিহাসিক প্রতিরোধ সংগ্রামে আজাদ মুনির সহ নয়জন শহীদ হন।
কমরেড তোয়াহার নেতৃত্বে নোয়াখালিতে, মন্টু মাস্টার ও এবাদ আলির নেতৃত্বে রাজশাহীর তানোরে, সালাউদ্দিন-হাজি বশীর-জাহেদদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে, খন্দকার আলি আব্বাসের নেতৃত্বে নবাবপুর থানা ও মানিকগঞ্জে গড়ে ওঠে অসামান্য গণসংগ্রাম।
দেবেন শিকদার, আবুল বাশারদের ‘বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ নোয়াখালি, চট্টগ্রামে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল। চাঁদপুরে এই দলের নেতা বিএম কলিমুল্লার গড়ে তুলেছিলেন বিরাট ঘাঁটি এলাকা। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ক্র্যাক প্লাটুনে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন এই বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন কমিউনিস্ট। তাদের অন্যতম শহীদ রুমি। এছাড়া ’৭১-এর এপ্রিলের শেষে বরিশালে ৭২ মাইলব্যাপি বিশাল পেয়ারাবাগানে সিরাজ শিকদারের বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায় রচনার কাজ শুরু করে। ঝালকাঠি থানার যাবতীয় অস্ত্র দখল করে এবং অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে পেয়ারাবাগানে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলে।
ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন এদেশের বামপন্থীদের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রাকপর্বে বামপন্থীদের ভূমিকাকে যতোই অস্বীকার ও অনুল্লেখ করা হোক, এক সময় দেশবাসী তা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন।
লেখক: সাংবাদিক, সাবেক ছাত্র নেতা।