বাঙলা ভাষার প্রথম বই,চর্যাপদ।বাঙলা ভাষার প্রথম প্রদীপ চর্যাপদ।এই আলোর ধারায় হাজার বছরের পথ হেটে বাঙলা ভাষা- সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে ফুলেফলে।চর্যাপদের কবিতাগুলো লিখেছিলেন ২৪ জন বৌদ্ধ বাউল কবি।এরা সবাই ছিলেন সর্বহারা।যাদের ঘর ছিলো না;বাড়ি ছিলো না।সমাজের নিচুতলার মানুষ ছিলেন আমাদের বাঙলা ভাষার প্রথম কবিকুল।এদের একজন দু:খী কবি সংসারের যন্ত্রণাকাতর,মর্মস্পর্শী দু:ষহ অভাবের কবিতা লিখেছেন তাঁর কবিতায়।ওই বাউল কবি লিখেছেন; ‘ টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।।বেঙ্গ সংসারবড়হিল জাঅ।দুহিল দুধ কি বেন্টে যামায়।।’কবিতায় কবি বলেছেন,টিলার ওপরে আমার ঘর,আমার কোন প্রতিবেশী নেই।হাঁড়িতে আমার ভাত নেই,প্রতিদিন আমি উপোস থাকি।বেঙের মতো সংসার বাড়ছে,যে- দুধ দোহানো হয়েছে তা আবার ফিরে যাচ্ছে গাভীর বাঁটে।সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকের নানামুখি
অত্যাচার- নিপীড়নের কথা,বেদনার কথা চর্যাপদে লিখেছেন – সর্বহারা বাউল কবিরা।বাংলা সাহিত্যে ১৮৮৬ সালের অনেক আগেই শ্রেণি সংগ্রামের সূচনা হয়েছিলো চর্যাপদে।আমাদের সংস্কৃতি লোকায়িত সংস্কৃতির বিকশিত রূপ।আমাদের গণসংস্কৃতি গণমানুষের নিজেদের সৃষ্টি।গণমাধ্যম সংস্কৃতির সঙ্গে লোকায়িত সংস্কৃতি এবং গণসংস্কৃতির পার্থক্য আকাশপাতাল।গণমাধ্যম সংস্কৃতি হলো গণমাধ্যমের পণ্য।গণমাধ্যম সংস্কৃতি ভোগের সাথে সম্পৃক্ত।বাঙলার লোকায়িত সংস্কৃতি সবসময় উঁচুতলা থেকে আক্রমনের মুখোমুখি হয়েছে।করা হয়েছে অবজ্ঞা, চরম অবহেলা।কিন্তু এর সৃজনশীলতা ও মানবিকতার উজ্জীবন শক্তিতে আমরা আলোকিত হয়েছি।আমাদের ভাষা,সংস্কৃতি- সাহিত্যের অগ্রায়ন ধারা এগিয়েছে লোকায়িত সংস্কৃতির আলোর পথ বেয়ে।
আজ মে দিবস।মে দিবসকেও আমাদের লোকায়িত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলাতে হবে।শ্রমিক- কৃষকের চেতনাকে শানিত করতে খুবই জরুরি ” গণসংস্কতির’ জাগরণ।শুধু রাজনীতির মেঠো বক্তৃতা দিয়ে ধর্মান্ধ অপশক্তি বা পুঁজিবাদি ভোগবাদী দুর্বিত্তপনাকে মোকাবেলা সম্ভব নয়।সমাজে চলমান সংকট সাম্প্রদায়িকতা,ক্রোধ,আর্তনাদ, বৈষম্য,অনাচার ইত্যাদির প্রতিবাদে মানুষের চিন্তা ও স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে গণসংস্কৃতি যুগেযুগে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে।গণসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছিল গণসংগ্রামের পথ ধরেই।চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে গণসঙ্গীত সঙ্গীত জগতে বঙ্গে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কাজী নজরুল ইসলামের- ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু; ‘ কারার ঐ লৌহকপাট; ‘জাগো অনশন বন্দি উঠরে যত’–এমন বহু গান গণমানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল সংগ্রামের অনুপ্রেরণায়।তেভাগা আন্দোলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের,” ও তোর মরা গাঙ্গে;সলিল চৌধুরীর ‘ হেই সামালো ধান হো’- ঐ গান আন্দোলনকারীদের প্রাণে জুগিয়েছিল প্রাণশক্তি।শেকড়ের চারপাশের মানুষের প্রাণ তৈরি হয় লোকসংস্কৃতি এবং গণসঙ্গীতে।গ্রাম- বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে সেক্যুলার মানবিকতার বোধ থাকে প্রবল।যা নাই নগরকেন্দ্রিক বিত্তবান এলিটদের মাঝে।এখন তো নগরে নগরে এলিট শ্রেণির মাঝে চলছে ভোগবাদের ভয়াবহ প্রতিযোগিতা।যা শ্বাশত বাংলার সুমহান ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে প্রতিদিন করছে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত।এরা নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করছে না।এই ভ্রষ্টাচারদের কাছে নারী ভোগের পণ্য!সব পক্ষের একই দৃষ্টিভঙ্গি। কথিত মওলানা আর অাধুনিক দরবেশ সবাই এখন এক কাতারে।বাঙালির লোক ঐতিহ্যে সব ধর্মের মানুষের মাঝে সমন্বয়ের সৃষ্টি করেছিল।যা গ্রাম বাংলার
বাউল,জারি,সারি,মরমি গানে,লালন,নজরুল, রবীন্দ্র সঙ্গীতে,কবি গানে,যাত্রা পালা,বাংলা নববর্ষে,চৈত্র সংক্রান্তি,ঈদ,পূজা পার্বন এবং নবান্ন উৎসবে আমরা দেখতে পাই।প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশ ও সমৃদ্ধি বাঙলার নিজস্ব লোকায়িত ঐতিহ্যকে ধারণ করে,লালন করেই তাকে উচ্চতর স্তরে নিতে হবে। চলতি রাজনীতিতে চলছে “সাংস্কৃতিক” সংকট ।একে রুখতে চাই ” লোকজ সংস্কৃতির” জাগরণ।পরিবার,সমাজ ও সংস্কৃতিতেও উজ্জীবিত করতে হবে শ্বাশত বাংলার লোকজ সংস্কৃতির মেলবন্ধন।
লেখকঃ অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী, পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।