যুগ যুগ জিও
এম এইচ নাহিদ ॥ ’৫৭-র কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন লাল মওলানা খ্যাত বাঙালির মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তাঁর দ্বিধাহীন স্পষ্ট উচ্চারণ-“হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু-মাঝখানে কিছু নেই।” একই সাথে তিনি আরো বলেছিলেন, “স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়; সমাজতন্ত্রও আনতে হবে।” তার সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন ’৭১-এ। তাই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার স্থপতি হলেও সেই স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁর নির্দেশিত পথেই এগোচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ’৭৫-এ কিছু কুলাঙ্গার যেমন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তেমনি নানাভাবে মওলানা ভাসানীর স্মৃতিকেও ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। গত ১৭ নভেম্বর ছিল মওলানা ভাসানীর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এবারো ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী ফলাও করে পালন করা হয় নি। গণমাধ্যমও মওলানাকে তুলে ধরার প্রয়োজনবোধ করে নি। যা তুলে ধরা হয়েছে তা নিতান্তই দায়সাড়া। ভিতরের পাতায় একেবারে গুরুত্বহীন নিউজের মতো। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজি, সা¤্রাজ্যবাদ আর বুর্জুয়ার তাবেদার বাজারি গণমাধ্যম যতই তাকে খাটো করে উপস্থাপন করুক, এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে মওলানা ভাসানীকে মুছে ফেলতে পারবে না।
কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামেই নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-সকল লড়াইয়ে ভাসানীর অবদান অপরিসীম। মওলানা হয়েও তিনি মুক্তমনা প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ^াস। তিনি ছিলেন বামপন্থীদের ভরসাস্থল। লড়াই করেছেন শোষিত-বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের জন্য। তার কাছে জালিমের যেমন কোনো জাত-ধর্ম থাকত না, তেমনি মজলুম মানুষ কোনো ধর্মের, দেশের, বর্ণের বা পেশার সেটা তিনি বিন্দুমাত্র ভাবতেন না। তিনি থাকতেন সর্বহারাদের মাঝে, ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির কাছে। তার মিত্র ছিল গরিব হিন্দু, গরিব মুসলমান। মেহনতি মানুষের লড়াইয়ে ভাসানী থাকতেন অগ্রভাগে। জেল-জুলুমের পরোয়া করতেন না। তাই তো তিনি হয়ে উঠেন মজলুম নেতা। আসামের ভাসান চরের মানুষ তার অগ্নিঝরা বক্তব্য শুনে নামের শেষে যুক্ত করেছিলেন ভাসানী।
তিনি মওলানা থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন লাল মওলানা। এক্ষেত্রে দেওবন্দ মাদ্রাসা ও দু’জন মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেওবন্দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। দেওবন্দের আবহাওয়াই ভাসানীকে অনেকটা পুরোদস্তুর বিপ্লবী করে তুলেছিল অন্য দু’জন ভাসানীকে তথাকথিত পীর মওলানা না বানিয়ে বিপুল বদলে দিয়ে মজলুম জননেতা বানিয়েছেন। তাদের একজন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও অন্যজন এক তরুণ মখলেসুর রহমান। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ভাসানী হয়ে ওঠার পিছনে কলিকাতায় থাকা বগুড়ার ছেলে মখলেছুরের অবদান অপরিসীম। তিনি ভাসানীর বুকে বিপ্লবের যে আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন তা জ¦লেছে আমৃত্যু। বাম মতাদর্শের প্রতি ভাসানীর বিপুল আগ্রহ ও শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সৃষ্টি সেখান থেকেই। তিনি ভাসানীকে বলেছিলেন,“শ্রেণিবিভক্ত সমাজে একদিকে সামন্ত ভূস্বামী, মহাজন, পেশাদার ধর্ম ব্যবসায়ী পীর-পুরোহিতরা, অন্যদিকে শত সহ¯্র দরিদ্র জনসাধারণ। শাসকের আইন বিধান আমাদের পাল্টাতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শোষণহীন এক নতুন সমাজ। ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার মতো আলেম-ওলামা এদেশে অনেক। পরকালের দিকনির্দেশনা তারাই করুক। আপনি শুধু ইহকালে যারা যন্ত্রণায় ছটফট করছে তাদের পাশে থাকুন।’’ এখান থেকেই তিনি লড়াই ও চেতনায় ধীরে ধীরে লাল মওলানা হয়ে ওঠেন।
মওলানা আব্দুল হামিদ খানের ডাক নাম ‘চেগ্যা মিয়া’। জন্ম সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর। সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও মওলানা ভাসানী তার জীবনের বড় অংশই কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। তিনি তার কৈশোর-যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অধিকার বঞ্চিত অবহেলিত মেহনতি মানুষের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় আজীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় সংকটে জনগণের পাশে থেকে মওলানা ভাসানী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি দেশ ও জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন। সর্বদা ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। ক্ষমতার কাছে থাকলেও ক্ষমতার মোহ তাকে কখনো আবিষ্ট করে নি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন নির্মোহ, অনাড়ম্বর ও অত্যন্ত সাদাসিধে। তার সাধারণ জীবনযাপন এ দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন। লড়াই করেছেন শোষণ ও বঞ্চনাহীন, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য। মওলানা ভাসানীই প্রথম মানুষের আত্মমর্যাদা ও নাগরিকত্বের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসে বর্তমান ভারত সরকারের এনআরসির পূর্বসূরী আসামের কুখ্যাত বাঙালি খেদাও বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও রাজনৈতিক জুলুম-নিপীড়ন ও লুটপাটের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান প্রতিবাদী কন্ঠ ছিলেন। মানুষের পাশে থেকেছেন দুর্ভিক্ষেও। জীবনের শেষ সময়েও সবার বাধা উপেক্ষা করে ছুটেছেন বাংলাদেশের মানুষ ও নদী বাঁচাতে ফারাক্কা লংমার্চে। দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন,” পিন্ডির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব করতে নয়।” তাই এদেশের লড়াই সংগ্রামের অপর নাম লাল মওলানা, মওলানা ভাসানী। সাম্প্রতিককালে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে, তা দেখে লাল মওলনা এদেশের ধর্মের নামে রাজনীতি করা মওলানাদের বজ্রহুঙ্কার ছেড়ে বলতেন-“খামোশ”। কিন্তু তিনি আজ নেই। ৯৬ বছর বয়সে চলে গেছেন ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর। তার পরেও তিনি আছেন কোটি বাঙালির হৃদয়ে। যুগ যুগ জিও তুমি মওলানা ভাসানী।