Sunday,8,December,2024
17 C
Dhaka
Sunday, December 8, 2024
Homeসীমানা পেরিয়েলিবিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘দাসের’ জীবন

লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘দাসের’ জীবন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥ উন্নত জীবনের আশায় কয়েক বছর ধরে নানা মাধ্যমে লিবিয়া যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। এরপরও নৌকায় চড়ে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয় নি। এছাড়া প্রতারণার শিকার হয়ে লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে বহু বাংলাদেশি আটক অবস্থায় আছেন। তাদের সঙ্গে ‘দাস’-এর মতো আচরণ করা হয়। মুক্তিপণ আদায়, শারীরিক নির্যাতন, খাবার না দেওয়া, মজুরি ছাড়া কাজ করানোসহ নানা দুর্ভোগ সহ্য করতে হয় তাদের। লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশিদের দুর্দশা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
এমন একজন ভুক্তভোগী মোহাম্মাদ আলী (ছদ্ম নাম)। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ওই তরুণ জানান, ২০১৯ সালে ১৯ বছর বয়সে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে তিনি কাজের খোঁজে লিবিয়ার উদ্যেশে ঝুঁকিপূর্ণ এক যাত্রা শুরু করেন। এক দালালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই তিনি এ ব্যাপারে উৎসাহী হন। প্রকৃতপক্ষে ওই দালাল হলেন মানবপাচারকারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁদ পেতে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ বাংলাদেশিদের আকৃষ্ট করা এ ধরনের দালালদের কাজ।
মুক্তিপণের জন্য আটক : লিবিয়ায় যেতে আলীর এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। বিমানবন্দরে নামার পরই একদল লোক তাকে নিয়ে যান। এসব লোক দালালদের হয়ে কাজ করে। তারা বিমানবন্দর থেকে আলীকে এক কারাগারে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর তারা আলীর কাছে থাকা টাকাপয়সা নিয়ে নেয়। এরপর মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আটকে রাখে। এরপর তারা আলীর বাবা-মাকে বিষয়টি জানায় এবং মুক্তিপণ দাবি করে। ছেলেকে মুক্ত করার জন্য বাড়িতে থাকা শেষ দুটি গরুও বিক্রি করে দেন বাবা-মা। ছোট একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয় আলীকে। যেখানে শোয়ার মতো কোনো বিছানাও নেই। ওই কক্ষে তার মতো আরো ১৫ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের মধ্যে যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেননি, তাদের খেতে দেওয়া তো হয়ই না, উল্টো নানাভাবে তাদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হয়।
আলী জানান, ‘আমার সামনেই তারা একজনকে মারধর করছিল। মার খেয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল । তবুও তাকে সাহায্য করেনি বা হাসপাতালে নেয় নি।’ ২০২০ সালের মে মাসে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির একটি গুদামঘরে একসঙ্গে ৩০ জন অভিবাসীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। বেঁচে যাওয়া একজন বলেন, পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেনি বলেই তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
মজুরি ছাড়াই কাজ : অবশেষে আলী মুক্ত হতে বেনগাজির একটি পানি বোতলজাত কারখানায় তিন মাস মানব পাচারকারীদের জন্য কাজ করছিলেন। পাচারকারীদের হাত থেকে কোনোমতে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি চলে যান ত্রিপোলিতে। সেখানে গিয়ে একটি টালি কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। বর্তমানে লিবিয়ায় থাকা আনুমানিক ২০ হাজার বাংলাদেশির অনেকেই আলীর মতো অত্যাচারিত হচ্ছেন। বেতন ও ছুটি ছাড়া কাজ করছেন।
আলী জানান, কাজ বন্ধ করলেই আমাদের মারধর ও লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হতো। তাদের চোখের আড়াল হতে দিত না। তালাবদ্ধ করে রাখা হতো সব সময়। তিনি বলেন, ‘মালিক আমাদের কাজে নিয়ে যেতেন এবং কাজ শেষ হলে আমাদের সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আমাদের নজরদারির জন্য দুজন রক্ষীও ছিল। ওই কাজের জন্য আমাদের কোনো মজুরি দেওয়া হতো না। এ ছাড়া সেখানে আমাদের পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না। পরে লিবিয়ার এক নাগরিক আমাকে পালিয়ে একটি মসজিদে আশ্রয় নিতে সাহায্য করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার।
সাগরে হাঙর : ছেলের ইতালি যাওয়ার কথা জানার পর আলীর বাবা-মা ছেলের জন্য আবার ঋণ করে সাড়ে তিন লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দেন। গত বছরের জুলাই মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ির ঘটনা আলীর ও নৌকায় থাকা অন্য ৭৯ অভিবাসীদের জন্য আরেকটি ভয়ংকর অগ্নিপরীক্ষায় পরিণত হয়েছিল। আলী বলেন, ‘পুরো দুই দিন সাগর ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখছিলাম না। হঠাৎ আমাদের কাছেই দুটি হাঙর দেখতে পেলাম। ওই সময় কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন যে, হাঙরগুলো আমাদের খেয়ে ফেলার জন্য আসছে। আমি তখন মনে করেছিলাম, এবার বুঝি আমরা শেষ।’ ইতালির উপকূলীয় শহর সিসিলিতে স্থানান্তরের আগে ল্যাম্পেডুসা নামের একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় আলীদের। আলী এখন সিসিলির রাজধানী পলিমারোর উপকণ্ঠে একটি বড় অভিবাসী আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে অন্য অনেক দেশের এমন অনেক তরুণ রয়েছেন।

সর্বশেষ