বেলাল বাঙালীঃ ২৮ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালির জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের দিন। গণতন্ত্র পুরুদ্ধারের দিন। ২০০৬ সালের এই ২৮শে’ই স্বাধীনতাবিরোধী দক্ষিণপন্থী অপশক্তির হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে লড়াইয়ে রাজপথে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। সেই লড়াইয়ে জীবন দিয়েছিলেন বাংলাদেশ যুব মৈত্রী’র নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মী শহীদ রাসেল আহমেদ খান। প্রচলিত গণমাধ্যমসমূহ ২৮ অক্টেবরের ইতিহাস গুরুত্ব দিয়ে প্রচার না করলেও ২৮ হলো বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ইতিহাসের নব দিগন্তের সূচনার দিন।
২০০১ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামাত চার দলীয় জোট। ক্ষমতায় এসেই তারা সীমাহীন দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বিরোধীদলের ওপর জুলুম নিপীড়ন শুরু করে। কেবল তাই নয় মৌলবাদী জঙ্গি হায়েনাদের দাপট বাড়তে থাকে রাষ্ট্রীয় মদদে। একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালানো হয়। সিনেমা হল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রমনা বটমূল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে ওরা দেশজুড়ে নারকীয় তাÐব চালায়। আর এসবই হচ্ছিল তারেক জিয়ার হাওয়া ভাবনের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুক‚ল্যে। ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে ওই হাওয়া ভবন। মৌলবাদী জঙ্গিবাদী দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। অন্যদিকে বিরোধীদের কণ্ঠকে চিরতরে রুদ্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনাও করা হয়।
দেশের মানুষ ধর্মীয় সশস্ত্র উগ্র জঙ্গিবাদ আর দুর্নীতি-দুঃশাসন থেকে মুক্তির পথ খুজতে থাকে। অন্যদিকে বিএনপি-জামাত জোট তাদের অপশাসনকে নানাভাবে দীর্ঘস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা সাধারণ মানুষের ভোটধিকার হরণ করে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মাধ্যমে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল। সে সময়ের কেএম হাসান-আজিজের কাহিনী সর্বজনবিদিত। বিএনপি-জামাতের সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৪ দলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তীব্র গণআন্দোলন। রাজধানী ঢাকা থেকে এই আন্দোলনের ঢেউ আঁছড়ে পড়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। মানুষ তাদের প্রতি নানাভাবে ধিক্কার ও নিন্দা জানাতে থাকে।
অবশেষে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর আসে বিএনপি-জামাত জোটের ক্ষমতা ছাড়ার দিন। তখনো সমাধান হয় নি তত্ত¡বধায়ক সরকার প্রধান নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের। বিএনপি চেয়েছিল তাদের আজ্ঞাবাহ সাবেক নেতা প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে। আর ১৪ দলীয় জোট চেয়েছিল নিরপেক্ষ কোনো মানুষকে। ২৭ অক্টোবর সকাল থেকেই তাই সারাদেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন জ¦লে ওঠে। বলতে গেলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। স্বত;স্ফুর্তভাবে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জামাত-বিএনপির নির্ধারিত উপদেষ্টা কেএম হাসানকে জনগণ কোনভাই মেনে নেবে না। বিএনপি-জামাতও গণদাবি মেনে নিতে প্রস্তত ছিল না। লড়াই হয় রাজপথে। ২৮ অক্টোবর সকাল থেকেই ১৪ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী লগি-বৈঠা নিয়ে পল্টনের জনসমাবেশে যোগ দেয়। সেদিন ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, আবাল বৃদ্ধবনিতা রাস্তায় নেমে আসে। পক্ষান্তরে বিএনপি-জামাত শিবির ক্যাডাররাও পল্টন ময়দান দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ১৪ দলের সর্বাত্মক প্রতিরোধের মুখে তারা বায়তুল মোকারমের উত্তর গেটে অবস্থান নেয়। পুলিশ পূর্বেই পল্টনে ১৪৪ ধারা জারি করে রাখে। জামাত শিবির ও বিএনপির দুর্বৃত্তরা পুলিশী পাহাড়ায় তড়িঘড়ি করে বায়তুল মোকররমে মঞ্চ নির্মাণ করে সমাবেশ শুরু করে। তারা মঞ্চ থেকে নানা উষ্কানিমূলক শ্লোগান ও বক্তব্য দিতে থাকে। অন্যদিকে গুলিস্তান, শহীদ নুর হোসেন চত্ত¡র, পল্টন মোড়, বিজয়নগর, প্রেসক্লাব, তোপখানা রোড, কাকরাইল, ফকিরাপুলসহ পুরো এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ১৪ দলের নেতৃত্বে জনতা বিএপি-জামাতের তত্ত¡বধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে বিক্ষোভ প্রতিবাদ চালাতে থাকেন। দুপুরের দিকে বিএনপি-জামাতের কর্মীরা হঠাৎ ১৪ দলের সমাবেশের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা মঞ্চ থেকে ঘোষণা দিতে থাকে ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’, ‘বৃষ্টির মতো গুলি কর’। জামাত শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা ১৪ দলের সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন দেশপ্রেমিক জনতা। সমস্ত্র জামাত-শিবির, বিএনপি ও পুলিশের বিরুদ্ধে কেবল লগি বৈঠা ইটপাটকেল দিয়ে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জামাত শিবিরের গুলিতে পল্টন মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন বাংলাদেশ যুব মৈত্রী’র নেতা রাসেল আহমেদ খান। গুলিবিদ্ধ রাসেলকে সহযোদ্ধারা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে রাসেল নিজের জীবন দিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধারের সংগ্রামে নিজের নামটি সংযোজন করেন। রাসেলের আতœদান এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অবদান হয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সাধারণ গণমানুষের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের এক অবিনাশী মন্ত্রের নাম শহীদ রাসেল আহমেদ খান।
রাসেলের আত্মত্যাগের পথ বেয়ে ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৪ দল ভ‚মিধ্বস বিজয় লাভ করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা অব্যাহত রাখে। ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর পালিত হলো রাসেলের আত্মদানের চতুদর্শ বার্ষিকী। ইতোমধ্যে আরো দু’টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কার্যত এখনো সংহত হয়েছে বলে মনে হয় না। এখনো দুর্নীতি-লুটপাট, অর্থ পাচার, শোষণ-বৈষম্য ও দুঃশাসন বিদ্যমান। যতো দিন মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ কায়েম না হবে ততো দিন শহীদ রাসেলদের আত্মত্যাগ যথার্থ পরিণতি অর্জন করবে না। ২৮ অক্টোবর এলেই রাসেলরা বার বার ডাক দিবে জাগো বাংলাদেশ।