অমল সেন ট্রাস্টের উদ্যোগে দাতব্য চিকিৎসালয়ের উদ্বোধন
মলয় কান্তি নন্দী : ইতিহাসখ্যাত নড়াইলের তে-ভাগা আন্দোলনের অগ্রপথিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড অমল সেনের অষ্টাদশ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে নড়াইল যশোরের সীমান্তবর্তী বাঁকড়ীতে দুদিনব্যাপী অমল সেনের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, আলোচনা সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের আয়োজন করা হয়েছিল। ‘কমরেড অমল সেন স্মৃতি রক্ষা কমিটি’র উদ্যোগে দু’দিনব্যাপি এ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়েছে ১৮ জানুয়ারি সোমবার।
১৭ জানুয়ারি রোববার বেলা বারোটায় অমল সেন স্মৃতি রক্ষা কমিটির মাল্যদানের মাধ্যমে দুদিনব্যাপী এই কর্মসূচির সূচনা হয়। তারপর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসমূহ কমরেড অমল সেনের সমাধিতে পৃষ্পমাল্য অর্পণ করেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড মাহমুদুল হাসান মানিক দলের কেন্দ্রীয় কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে কমরেড অমল সেনের সমাধিতে মাল্যদান করেন এবং বিকালে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন।
বেলা তিনটায় কমরেড অমল সেন স্মৃতি ট্রাস্টের নির্ধারিত জায়গায় কমরেড অমল সেন দাতব্য চিকিৎসালয়ের উদ্বোধন করেন এগারোখান জনকল্যান ট্রাস্টের সভাপতি ও কমরেড অমল সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নারায়ন চন্দ্র পাঠক। এসময় অমল সেন ট্রাস্টের অন্যতম ট্রাস্টি কমরেড মাহমুদুল হাসান মানিকসহ ওয়ার্কার্স পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও এলাকার সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
বেলা চারটায় এগারোখান জনকল্যার ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক অশ্বিনী কুমার দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও নড়াইল জেলা সভাপতি কমরেড এ্যাড. নজরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যশোর জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড ছব্দুল হোসেন, শিক্ষক নেতা প্রফেসর রবিউল ইসলাম, কমরেড কিশোর রায়, কমরেড মোস্তাফিজুর রহমান লাল, কমরেড অমল সেন স্মৃতিরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, কমরেড প্রতীক রায়, যুব মৈত্রী নেতা অনুপ কুমার পিন্টু, ছাত্র মৈত্রী নেতা শ্যামল শর্মা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ যুভ মৈত্রী ও ছাত্র মৈত্রীর কর্মীবৃন্দ কমরেড অমল সেনের সমাধিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেন। দ্বিতীয় দিন ১৮ জানুয়ারী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। কোভিড-১৯ বাস্তবতায় এবারের আয়োজন সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে জানালেন ‘কমরেড অমল সেন স্মৃতি রক্ষা কমিটি’র সম্পাদক অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
কমরেড অমল সেন ১৯১৪ সালের ১৯ শে জুলাই আউড়িয়ার প্রখ্যাত রায় পরিবারে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নড়াইলের আফরার জমিদার পরিবারেরর সন্তান। নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী ‘অনুশীলন’ গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত হন। দৌলতপুর বিএল কলেজে গনিতশাস্ত্রে সম্মান শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মার্কসবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখে বাড়িতে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আব্দোলন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন মানব জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হতে পারে মানব সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা তথা শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তির লড়াইতে অংশগ্রহণ করা। তাই তিনি পরিবারের জমিদারীর উত্তরাধিকার পরিত্যাগ করে বাড়ি ছেড়ে এক কৃষক পরিবারে এসে আশ্রয় নেন আর আমৃত্যু নিজেকে কৃষক, শ্রমিক মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত রাখেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনিই নড়াইলের প্রথম কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংগঠক। ১৯৩৩ সালে নড়াইলের সরসপুর গ্রামের মৎস্যজীবীদের জলার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মৎস্যজীবীদের সংগঠন গড়ে তোলেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি ইজারা প্রথা, হাটতোলা ইত্যাদি খাজনা বন্ধের জন্য গোবরা, আগদিয়া, তুলারামপুর, ধলগ্রাম, মাইজপাড়া এবং মাদ্রাসার হাটসহ ব্যাপক অঞ্চলে হাটতোলা বন্ধের আন্দোলনে কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং বিজয়লাভ করেন। কমরেড অমল সেন তেভাগা সংগ্রামে কৃষকদের ব্যাপকভাবে সংগঠিত করাবার জন্য বাকড়ি, হাতিয়াড়া, গোয়াখোলা, বাকলি, মালিয়াট, দোগাছি, ঘোড়ানাচ, কমলাপুরসহ এগারোখানের গ্রামগুলিসহ বড়েন্দার, বীড়গ্রাম, উজিরপুর, চাঁদপুর, দুর্গাপুর, ডুমুরতলা, দলজিৎপুর এসকল গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করেন। এই তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে গরীব কৃষকদের মধ্য থেকে একঝাঁক বিপ্লবী কর্মী গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনে তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নূরজালাল মোল্লা, মোদাচ্ছের মুন্সী, হেমন্ত সরকার, বটু দত্ত, রসিক ঘোষ. আজিজুর রহমান, বামাচরণ গোলদার, সরলা সিং প্রমুখ।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তিনটি পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে অমল সেন সে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে ৬টি কমিউনিস্ট পার্টি সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও কমরেড সেন নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টির ঐক্যের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি হন তিনি। কমরেড অমল সেনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে রাশেদ খান মেনন এমপি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তাঁর আপোসহীন ভূমিকার কারণে জীবনের উনিশটি বছর তাকে কারান্তরীণ থাকতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ স্বাধীনতাকামী বীর জনতা যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পার্টি কর্মীদের একাংশের সাথে মতবিরোধ হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারত গমন করেন এবং সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ করে যান। স্বাধীনতার পরে তিনি বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং মৃত্যুর পূর্বে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০০৩ সালের ১৭জানুয়ারি বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন আজীবন বিপ্লবী কমরেড অমল সেন।