আসছে করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট
নতুন কথা প্রতিবেদন ॥ আসছে করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেট। চলছে প্রাক বাজেট ভাবনা। প্রশ্ন উঠেছে, এবারের বাজেটে করোনা মোকাবিলা, বিধ্বস্ত অর্থনীতি, গণস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা পুনরুদ্ধারের মতো জরুরি বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে কি না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দক্ষজনবল তৈরির জন্য প্রশিক্ষণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তারা চান কর্মসংস্থানমুখী বাজেট। আর রাজনীতিবিদরা বলছেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, “করোনা সংঙ্কট মোকাবিলায় এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। যাতে করোনাকালেও দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে আমরা স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে পারি। একই সাথে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসাসহ সকল বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে বাজেট ঘোষণা করলে তা হবে জনগণের বাজেট।” রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সচেতন মানুষের প্রত্যাশা গণমুখী বাজেট। অর্থমন্ত্রণালয় সুত্রে জানাগেছে, ৯ লক্ষ্যকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ণে কাজ করছে বর্তমান সরকার। তবে ফি বছরের মতো এবারো কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সহ ধনী তোষণেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বাজেট কেবল বাজেট নয়, এটা সাথে জড়িত দেশবাসীর জীবন-জীবিকার প্রশ্ন। করোনার এই মহাসংকটে জীবন বাঁচানোই প্রথম প্রশ্ন। আর বেঁচে থাকলে খেতেও হবে। ফলে দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে জীবিকা। তার জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান। একই সাথে প্রয়োজন শিক্ষা। আর দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় দরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা যে কৃষি, তা করোনাকাল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং গুরুত্ব দিতে হবে কৃষিতেও। তবে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলবে কেবল দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে। এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করলে, তবেই সেই বাজেট হবে কর্মমুখী বাজেট-অভিমত রাজনৈতিক নেতা ও অর্থনীতিবিদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষিখাতে অগ্রাধিকার ঘোষণা এবং বরাদ্দ বাড়ালেই বাজেট জনগণের বাজেট বা ইতিবাচক হয় না, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ালেই মহামারী মোকাবিলা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অটোমেটিক্যালি বাড়ে না, যদি এ খাতের ব্যয়ের সক্ষমতা ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন বহাল থাকে, দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা-অপারগতায় আকীর্ণ থাকে এবং তা নিরসনে পদেেক্ষপ না নেওয়া হয়। তারা বলছেন, করোনা সংকটে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের কর্মসংস্থান। এসব বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মতো খাতগুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্য।
রাজনীতবিদরা বলছেন, বাজেটে করের বোঝা কমিয়ে রাজস্ব বাড়াতে সম্পদশালীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করতে হবে। এ লক্ষ্যে সম্পদ কর বা সারচার্জ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার চেয়েছেন রাজনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ এবং তা ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দরকার। অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ ও আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় আগ্রহী-উৎসাহ দিতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে। সচেতন মহল থেকে দাবি তুলেছেন, দারিদ্র্যতা, নদীভাঙন ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবং কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকায় ভিড় করছেন। মেগাসিটি ঢাকায় ৩০ হাজারের বেশি বস্তিতে প্রায় ৩৫ লাখ লোক বাস করে। এদের বিষয়েও বাজেটে গুরুত্ব দিতে হবে। তারা বলছেন, দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। আরো রয়েছে লাখ লাখ পথশিশু। দীর্ঘমেয়াদি করোনা পরিস্থিতির কারণে পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যার ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাই এবারের বাজেটে শিশুদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে নজর দিতে বলেছেন খোদ সরকার দলীয় নেতারাও।
অনেকেই অসংগঠিত খাতের শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথাও ভাবতে বলেছেন। এছাড়া করোনায় অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন, সকল ধরনের পরিবহন শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এক কথায় বলতে গেলে সকল স্তরের মানুষ-বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই এবারের বাজেটে দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে-বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা; কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সফল বাস্তবায়ন; কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া; অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সেচ ও বীজ প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, সারে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা; ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ; সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ; গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন; নি¤œআয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু রাখা এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন।
বিশ্লেষকরা বলছেন এসব লক্ষ্য পূরণে যেমন কাজ করতে হবে, তেমনি জনগণের কল্যাণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও কৃষিতে গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে বাজেট কখনোই গণমুখী বাজেট হবে না। সকলেই চান গণমুখী বাজেট।