।। খান আসাদ ।।
“মার্ক্সবাদ” পাঠ থেকে আমরা কিছু বিষয়ের ধারনা পাই। যেমন, দ্বন্দ্ববাদ, শ্রেণি, শোষণ, সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তন, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের ধারনা। মার্ক্সবাদ পাঠে জানা যায়, বৈষম্য ও সহিংসতার সমাজ বাস্তবতা কেন, এর শ্রেণীচরিত্র ও রাজনৈতিক অর্থনীতি। জানা যায়, এই সমাজবাস্তবতা থেকে মুক্তির জন্য বিপ্লবের কৌশল সম্পর্কেও। ফলে, মার্ক্সবাদ প্রচলিত শ্রেণী সমাজব্যবস্থার সমালোচনা ও মানুষের মানবিক সাম্যের সমাজের আশাবাদ।
ইতিহাসের কিছু কৌতুক আছে। আজকের জার্মানিতে শ্রেণিবাস্তবতা বোঝার জন্য আপনি মার্ক্সবাদীদের তেমন কোন গ্রহণযোগ্য গবেষণা পাবেন না। কিন্তু পুঁজিবাদী গবেষকেরা শ্রেণিবিশ্লেষণ করেন, খুব ডিটেলে। না, বিপ্লবের জন্য না। বিভিন্ন শ্রেণীর রুচি ও ক্রয়ক্ষমতা বোঝার জন্য। শ্রেণীর ধারনা এদের দরকার, বাজার সম্প্রসারণ ও মুনাফার জন্য।
আজকে আমরা সমাজগবেষণায় “সিস্টেম থিংকিং” এর কথা বলি। অর্থাৎ বৈষম্য ও সহিংসতার কারণ খুঁজতে গিয়ে, আমরা নানা দ্বন্দ্ব বোঝার চেষ্টা করি এবং এই দ্বন্দ্ব যে অনেক ব্যক্তি, শ্রেণী, প্রতিষ্ঠান এবং এদের সকলের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় ঘটে, এটা যে সিস্টেমিক বা কাঠামোগত, তা প্রায় কাণ্ডজ্ঞান হয়ে গেছে। সমাজবিজ্ঞানের এই পদ্ধতি, দ্বন্দ্ব ও সিস্টেম বোঝার চেষ্টা, মূলত মার্ক্সবাদী।
মার্ক্সবাদের বাইরে “নারীবাদী” গবেষণা ও সাহিত্য আমাদের আরেকটি মৌলিক বৈষম্য ও সহিংসতা ব্যাখ্যা করে। যার নাম পিতৃতন্ত্র। শ্রেণী বৈষম্যের আলোচনা ছিল মার্ক্সবাদের প্রধান বিষয়। নারীবাদের বিশ্লেষণে প্রধান বিষয় ছিল লিংগিয় বৈষম্য। এখন লিংগিয় বৈষম্য বুঝতে গিয়ে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে শ্রেণী, জাতি, বর্ন, অপরাপর লিংগিয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও সহিংসতার আলোচনা। এটাকে বলে ইন্টারসেকশনালিটি।
সম্প্রতি, শোষক-শোষিত, নিপীড়ক-নিপীড়িত, দায়ী-নির্দোষ, – এই রকম সাদাকালো বা অতিসরল ভাবে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা ব্যাখ্যার একটি সমালোচনা শুরু হয়েছে। (যুতসই রেফারেন্সঃ The Implicated Subject: Beyond Vicims & Perpetrators, by Michayel Rothberg). যেখানে ব্যক্তির ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠেছে।
সহজ করে বললে, অতীতের সকল গণহত্যার ক্ষেত্রে কিংবা আজকের সকল বৈষম্যের দায় থেকে কেউই আমরা নির্ভেজাল বিচ্ছিন্ন বা মুক্ত না। আমাদের সকলের কম বেশি দায় আছে। যেমন, পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের ভুমিবেদখলে আমাদের “বাঙ্গালীদের” সকলের কম বেশি দায় আছে। “আমিতো আর রাঙ্গামাটি গিয়ে জমি কিনিনি, ফলে আমি দায়মুক্ত”। এটা সত্যের একদিক, কিন্তু অন্যদিকে বাঙ্গালীদের দ্বারা ভূমি বেদখল নিয়ে কথা না বলা, পরোক্ষে ভূমিদখলে সহায়তা করা।
এই ধারনা একটি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দায়িত্বগ্রহণের প্রশ্ন সামনে আনে। “আমি হিন্দুর জমি দখল করি নাই, আমি সাম্প্রদায়িক না, কিংবা আমি ঘুষ খাইনি ফলে আমি দুর্নীতি করছিনা, অথবা আমি বউ পিটাইনা, আমি ভালো পুরুষ” – এমন ধরনের ভাবনাকে প্রশ্ন করে। উৎসাহ দেয়, ব্যাক্তি আমার সাথে সামাজিক বৈষম্য ও সহিংসতার সম্পর্ক খুঁজতে। বৈষম্য ও সহিংস ক্ষমতার সাথে ব্যাক্তিসংশ্লিষ্টতার সম্পর্ক উন্মোচন।
এবারে, তিনটে তাত্ত্বিক ধারনা, (১) মার্ক্সবাদের শ্রেণী ও সমাজবিপ্লব, (২) নারীবাদের ইন্টারসেকশনালিটি বা সব ধরনের (শ্রেণীর বাইরেও) বৈষম্য ও সহিংসতার অন্তর্ভুক্তি, এবং (৩) দোষী-নির্দোষ ধারনার বাইরে গিয়ে আত্মসংশ্লিষ্টতার (Implicated Subject) সচেতন সংবেদনশীল উপলব্দিকে মিলিয়ে দেখি, তাহলে আমরা এক নোতুন রাজনীতি ও নোতুন সমাজবিপ্লব কৌশলের কথা চিন্তা করতে পারি। আমরা, সকল ধরনের বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অবস্থান ঘোষণা করতে পারি, বৈশ্বিক সংহতি গড়ে তুলতে পারি, ও বিশ্ববিপ্লবের পথে হাঁটতে পারি।
সিস্টেমথিংকিং থেকে আমরা জানি, বাংলাদেশের লুটেরাপুঁজি, দুর্নীতি ও মৌলবাদ বিকাশে নয়া-উদারবাদি “ওয়াশিংটন কনসেনসাশের” ভূমিকা। নারীবাদী আন্দোলন থেকে আমরা জানি, শোষণ বহুমাত্রিক, ঘরে বা বিছানাতেও ঘটে। তৃতীয়ত, আমরা জানি নিশ্চুপ থাকা মানে নিরপেক্ষতা নয়, সুবিধাবাদের দোষ। কেবল একজনকে বা এক দলকে দায়ী করেও লাভ নেই, কারণ তা সিস্টেমকে আড়াল করে মাত্র। শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বদল নিয়ে ভাবনাও যথেষ্ট নয়। কারণ বাংলাদেশ পুরো বিশ্বব্যবস্থার অংশ।
প্রয়োজন বৈশ্বিক সকল আন্দোলনে (যেমন ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার) বাংলাদেশের বিপ্লবীদের অংশগ্রহণ। আবার বাংলাদেশের বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে বার্লিনের রাস্তায় যেন প্রতিবাদ সভা আয়োজন করে জার্মান “ফ্রাইডে ফর ফিউচার” এর কর্মীরা। আজকের বিপ্লবীদের হাতে প্রযুক্তি আছে, বিশ্ববিপ্লবের।
তত্ত্ব ও অনুশীলন নিয়ে এই সময়কার বিপ্লবী তরুণদের একটি বিভ্রান্তির আলোচনা করে শেষ করতে চাই। অনুশীলন তিন ধরনের, চিন্তার অনুশীলন, সাংগঠনিক অনুশীলন ও আন্দোলনের অনুশীলন। সকল প্রকার অনুশীলনের প্রতিই সমান গুরুত্ব দেয়া দরকার। চিন্তার অনুশীলন সম্ভবত, সবচেয়ে প্রাথমিক গুরুত্বের।
আমরা গোটা দুনিয়াকেই বদলাতে পারি, ব্যক্তিসংশ্লিষ্টতা দিয়ে। বিশ্ববিপ্লবে অংশ নিয়ে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।